পড়ালেখায় প্রযুক্তি যেভাবে জায়গা করে নিল

ডিজিটাল লার্নিং বড় পরিসরে অনেক সুফল বয়ে আনলেও কিছু চ্যালেঞ্জের দিকও রয়েছে
কৃতজ্ঞতা: ড্যাফোডিল কলেজ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকেই যেন একটা টাইম মেশিনে বসিয়ে দিয়েছিল করোনাকাল। নইলে অনলাইন ক্লাস, ব্লেন্ডেড লার্নিং…কথাগুলো কি এত দ্রুত পরিচিতি পেত?

কম্পিউটার আসার আগেই কিন্তু পড়ালেখায় রেডিও, টেলিভিশনের মতো যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তখনো আলোচনা হতো, এসব প্রযুক্তি শেখার জায়গাকে বিস্তৃত করবে৷ একজন শিক্ষক যেমন আরও বেশি শিক্ষার্থীকে শেখাতে পারবেন, শিক্ষার্থীও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পড়ালেখা গুছিয়ে নিতে পারবে।

নব্বইয়ের দশকে ব্রডব্যান্ড ও কেব্‌ল কানেকশন জনপ্রিয় হতে থাকে। বাড়তে থাকে ইন্টারনেটের ব্যবহার। ব্যক্তিগত কম্পিউটারের প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে শিক্ষাপ্রযুক্তি ওয়েবে যেতে শুরু করে। সুযোগ গ্রহণ করে কলাম্বিয়া ও ইয়েলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়। অনলাইন কোর্সের ওপর বড় বিনিয়োগ করে তারা। ফলে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই অনলাইন কোর্সে আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। মজার ব্যাপার হলো করোনাকালেরও আগে সেই ২০১২ সালেই এত পরিমাণে অনলাইন কোর্স চালু হয়েছিল যে বছরটিকে ‘দ্য ইয়ার অব দ্য এমওওসি’ (ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস) ঘোষণা করে নিউইয়র্ক টাইমস।

ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তি বইয়ে অনেকেই বড় আকারের কম্পিউটারের ছবি দেখেছেন। এক রুম সমান জায়গা নিয়ে এসব যন্ত্র পরিচালিত হতো। সে সময়ই সিএআইয়ের (কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড ইনস্ট্রাকশন বা কম্পিউটারের সহায়তায় পাঠদান) ব্যাপারে প্রথম সবাই জানতে পারে৷ অর্থাৎ কম্পিউটার একটা প্রশ্ন করত, একজন শিক্ষার্থী উত্তর দিত। উত্তর ঠিক হলে যন্ত্রটি নিজেই উত্তরদাতাকে অভিনন্দন জানাত, ভুল হলে আবার চেষ্টা করতে বলত। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যাট্রিক সাপেস ১৯৬৬ সালেই আমেরিকার একটি বিজ্ঞান প্রবন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘সামনের আরও কয়েক বছরের মধ্যে লাখো স্কুলের বাচ্চারা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মতো রাজকীয় ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ পাবে, যেখানে ব্যক্তিগত শিক্ষক হবে অ্যারিস্টটলের মতোই জ্ঞানী ও দ্রুত উত্তর প্রদানকারী।’ এই অধ্যাপক মূলত কম্পিউটারকেই শক্তিশালী এক ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে বুঝিয়েছেন।

বাংলাদেশে ডিজিটাল শিক্ষা

করোনার সময়েই মূলত বাংলাদেশে অনলাইনে শেখা বা ডিজিটাল মাধ্যমে শেখার ধারণা এত জনপ্রিয়তা পায়৷ অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা এই আধুনিক টুলসগুলোকে সাদরে গ্রহণ করেন। তবে অনলাইনের সহায়তায় পড়ালেখার চল আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। উদ্ভাসের ইউটিউব চ্যানেল ‘অন্য রকম পাঠশালা’ ২০১২ সাল থেকেই ভিডিও আপলোড করা শুরু করে। ২০১৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘টেন মিনিট স্কুল’-এরও জনপ্রিয়তা পেতে সময় লাগেনি। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের যেসব তত্ত্বের ব্যবহার মনে মনে চিন্তা করতে হতো, প্রযুক্তির আশীর্বাদে অনেক কিছুই এখন চোখের সামনে দেখতে পান শিক্ষার্থীরা। করোনা–পরবর্তী সময়ে কাজ শুরু করা ‘শিখো’, ‘বন্দী পাঠশালা’র মতো দেশের অনলাইন পাঠদানের প্ল্যাটফর্মগুলোও কাজ করছে পুরোদমে।

বন্দী পাঠশালার শুরুর দিক থেকেই শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন ডা. সাজ্জাদ হোসেন। জীববিজ্ঞান পড়ান এই তরুণ শিক্ষক। শেখানোর এই নতুন ধরন নিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার সময় সবাই অলস সময় পার করেছিল। তখনই উদ্যোগ নিয়ে আমরা বিভিন্ন রকম প্ল্যাটফর্ম খুলে বসি। তেমনই একটা প্ল্যাটফর্ম বন্দী পাঠশালা। গত তিন–চার বছরে আমি ডিজিটাল লার্নিংয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখেছি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেটের কল্যাণে পড়ালেখা এখন অনেক সহজ হয়েছে। একটি গ্রামে হয়তো ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকে না, ইন্টারনেটও শক্তিশালী নয়। সেখান থেকেও শিক্ষার্থীরা আমাদের মাধ্যমে শিখছে। কারণ, মেধাবী শিক্ষকদের সমন্বয়, পড়ানোর আধুনিক কৌশল, প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁদেরকে সহজে পড়া বুঝতে সাহায্য করছে। যার ফলাফল আমরা বোর্ড পরীক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় দেখতে পাচ্ছি।’ এর দ্বারা একদিকে যেমন মোবাইলের মাধ্যমে শেখা যাচ্ছে, একই সঙ্গে সময়ের অপচয়ও কমেছে বলে মনে করেন তিনি।

এখন পড়ালেখার সহযোগী অনলাইন কোর্স বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বছরব্যাপী একাডেমিক কোর্স, পরীক্ষার আগে স্বল্পমেয়াদি কোর্স ছাড়াও থাকে মডেল টেস্ট। শিক্ষার্থীরা কি উপকৃত হচ্ছেন? রংপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রুকাইয়া আহমেদ বলেন, ‘স্বনামধন্য প্ল্যাটফর্মগুলো ভালোই শেখায়। বড় প্ল্যাটফর্মে কোচিং করতে গেলে আমরা সব সময় শুনতে পাই, সেরা শিক্ষকেরা ঢাকায় ক্লাস নেন। তখন মনে হয়, ঢাকার শিক্ষার্থীরা শেখার সুযোগ বেশি পায়। এখন এই সমস্যা অনেকটা কমেছে৷ ঘরে বসেই আমরা দেশের স্বনামধন্য শিক্ষক, ভাইয়া-আপুদের ক্লাস করতে পারি।’

টেন মিনিট স্কুলে রসায়ন শেখান মিল্টন খন্দকার। তাঁর বক্তব্য, ‘করোনার আগে অনলাইন সোর্স থেকে লেখাপড়ায় আমাদের শিক্ষার্থীদের তেমন আগ্রহ ছিল না। তখন পড়াশোনার জন্য পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন ক্লাস ও কনটেন্টও খুব বেশি ছিল না। করোনার স্থবিরতা দুটো কাজ করেছে। এক. শিক্ষকদের অনলাইনে পড়ানোর সুযোগ ও সময় দিয়েছে। দুই. ঘরে বসেই শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব—এই ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে শিক্ষার্থীরা৷ শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পড়ালেখা করতেই এখন বেশি আগ্রহী। কারণ, শেখার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অনলাইনেই বেশি। রসায়ন শিক্ষক হিসেবে আমি খেয়াল করে দেখেছি, অনলাইনে বিভিন্ন রিসোর্স ব্যবহার করে ভিডিওর মাধ্যমে চমৎকারভাবে রসায়নের নানা বিষয় বোঝানো সম্ভব, উপস্থাপন করা সম্ভব; ক্লাসরুমে সেভাবে হয়তো সেটা সম্ভব না।’

এ তো গেল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করা শিক্ষকদের কথা। কিন্তু যেসব শিক্ষক সরাসরি ক্লাসে শেখান, তাঁরা কী ভাবছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব কার্যক্রমেও দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজেসের সিনিয়র লেকচারার ফারিনা হক। বর্তমানে তাঁর গবেষণার একটা অংশ ডিজিটাল শিক্ষাকেন্দ্রিক। তাঁর বক্তব্য, ‘মহামারির আগে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার মূলত প্রযুক্তি নিয়ে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ অল্প কিছু গবেষক এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন এবং সম্ভাবনার কথা বলতেন। বিনোদন বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি থাকলেও শ্রেণিকক্ষে এর ব্যবহার সীমিতই ছিল৷ পেডাগোজি বা শিক্ষাবিজ্ঞানে আমরা অ্যাসিনক্রনাস লার্নিংকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখি। সহজভাবে বললে, শিক্ষার্থী তার নিজ দায়িত্বে নিজের সময় অনুযায়ী পড়াটা তৈরি করে নেবে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করবেন। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে শুধু শিক্ষকের লেকচারের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। বরং নিজের চেষ্টায় জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে। আর এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।’

ডিজিটাল লার্নিং বড় পরিসরে অনেক সুফল বয়ে আনলেও কিছু চ্যালেঞ্জের দিকও রয়েছে। এই ইংরেজি শিক্ষক যোগ করলেন, ‘সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো মনোযোগের ঘাটতি। চারদিকে এত বেশি তথ্য, এত বেশি “গো-উইথ-দ্য-ফ্লো” অর্থাৎ গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, এত রকম বিনোদন গ্রহণের সুযোগ যে মনোযোগ ধরে রাখাটা আসলেই কঠিন। তার মধ্যে আছে নিজে থেকে চিন্তা না করার অভ্যাস। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হয়তো মনে হচ্ছে “কিছু নম্বর পাওয়ার জন্য এত কষ্ট করে কী হবে! অনলাইনে সার্চ দিলে তো সবই পাওয়া যায়।” কুম্ভিলকবৃত্তি (প্লেজিয়ারিজম) ঠেকানোর ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন শক্ত ভূমিকা রাখছে, একই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে হবে যে পড়াশোনা শুধু নম্বর পাওয়ার জন্যই নয়, বরং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা যদি স্বাধীন চিন্তাবিদ হতে পারে; সেটাই হবে শিক্ষার আসল সফলতা।’