স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাকরি ছেড়েছিলেন সমীর

স্ত্রী নাজিয়াতের স্বপ্ন পূরণ করতে সন্তানকে দেখাশোনার জন্য নিজের চাকরি ছাড়েন সমীর
ছবি : অগ্নিলা আহমেদ

‘মানুষের কথা শুনে সব সময় যে স্ট্রং থাকতে পারতাম, তা নয়। মাঝেমধ্যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম। দিন শেষে আমিও তো বাঙালি পুরুষ। ফলে যখন কেউ পৌরুষে আঘাত দিয়ে কথা বলত, গায়ে লাগত খুব। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবতাম, দুজনের মধ্যে কেউ একজন যদি এগিয়ে যায়, কারও স্বপ্ন যদি পূরণ হওয়ার পথ খোলা থাকে, তাহলে সেটাতেই সাহায্য করা উচিত,’ বলছিলেন শামসুদ্দিন খন্দকার। কাছের মানুষদের কাছে সমীর নামেই যিনি পরিচিত বেশি। কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন তাঁর স্ত্রী নাজিয়াত ইসলাম। ২০১৮ সালে তাঁদের একমাত্র সন্তান আয়দিনের বয়স যখন আট মাস, তখন সেখানে চাকরির সুযোগ পান নাজিয়াত। বেতন তো ভালো ছিলই, পাশাপাশি এটা ছিল নাজিয়াতের স্বপ্নের চাকরি। সমীর তখন কাজ করতেন চট্টগ্রামের ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং (শিপিং) সেক্টরে। স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে সেই সময় নিজের চাকরি ছাড়েন সমীর। নতুন শহরে সন্তানকে দেখাশোনা করতে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কর্মক্ষেত্রে চলে আসেন।

চাকরির সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক ওই উন্নয়ন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা নাজিয়াতকে প্রশ্ন করেছিল, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে কাজটি অনেক কঠিন হবে। আপনি কী তার জন্য প্রস্তুত আছেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, একজন নতুন মা হিসেবে পৃথিবীর কঠিনতম কাজটি করছি। এখন আমার মনে হয় পৃথিবীর সব কাজই পারব। মৌখিকভাবে তখনই চাকরিটি নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে মনে যে সংশয় ছিল না, তা নয়। এত ছোট সন্তানকে নিয়ে অপরিচিত শহরে কাজ করা একবার অসম্ভবও মনে হচ্ছিল। অন্যদিকে চট্টগ্রামে তাঁরা দুজনে মিলে যে পরিমাণ আয় করছিলেন, নতুন সংস্থাটি তার দ্বিগুণ বেতন প্রস্তাব করে। বেশ দোলাচলেই পড়ে যান নাজিয়াত।

নাজিয়াত যখন অফিসে থাকতেন, তখন সমীর ছেলে আয়দিনের খাওয়া, ঘুম, গোসল, যত্ন—সবই এক হাতে সামলেছেন

অবশ্য শুরু থেকেই সাহস দিচ্ছিলেন সমীর। নাজিয়াতের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করার স্বপ্নের বিষয়ে তিনি জানতেন। বারবারই বলছিলেন, ‘যদি অফার লেটার দেয়, অবশ্যই জয়েন করবে।’

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কক্সবাজার অফিসে নাজিয়াত যখন যোগ দেন, তখন নিজের সিদ্ধান্তে চাকরি ছেড়ে আয়দিনকে নিয়ে সমীরও তাঁর সঙ্গী হন। শুরু হয় তাঁদের নতুন জীবন। ভোরে কাজে বেরিয়ে যেতেন নাজিয়াত, হোটেলের কামরায় কাটত বাবা-ছেলের সময়। সেসময় আয়দিনের খাওয়া, ঘুম, গোসল, যত্ন—সবই এক হাতে সামলেছেন সমীর। আয়দিন কোনোভাবেই যেন মায়ের অভাব বোধ না করে কিংবা নাজিয়াতের কাজে যেন কোনোভাবে মনঃসংযোগ ব্যাহত না হয়, সেই চেষ্টা করেছেন।

চট্টগ্রাম ছাড়ার আগে নাজিয়াতের এক সহকর্মী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, ১৫ দিনের বেশি টিকতে পারবেন না। নাজিয়াত বলেন, ‘১৫ দিনে সত্যিই আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা তখন ভীষণ কঠিন ছিল। প্রতিদিন মনে হতো, পালিয়ে যাই। সেই সময় আমাকে সাহস দিয়েছে সমীর। যখনই হাল ছেড়ে দিয়েছি, বলেছে, এখন ফিরে গেলে নিন্দুকেরাই জয়ী হবে। যারা বলেছিল আমি পারব না, তাদের কথাই সত্যি প্রমাণ হবে।’

স্বামীর এই সহযোগিতাই নাজিয়াতকে তাঁর স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে দেয়

সমীরের এসব কথাই পরের দিনের জন্য ‘ফুয়েল’ হিসেবে কাজ করত, ‘সারা দিন কাজ করে ওর গায়ের রং একদম পুড়ে গিয়েছিল। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতাম না। যেন আমাকে দেখে ও দুর্বল না হয়ে যায়। আয়দিনের কোনো সমস্যায় কখনো ওকে টেলিফোন করতাম না। আমি চাইতাম, ও সামনে এগিয়ে যাক। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সমর্থন দেওয়া যায়, আমি দেব।’ এভাবেই সমীরের সহায়তায় ধীরে ধীরে নতুন কাজের সঙ্গে মানিয়ে নেন নাজিয়াত।

এই দীর্ঘ সময় আর চাকরিতে ঢোকেননি সমীর। ছেলেকে দেখভালের পাশাপাশি বাড়িতে বসেই শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। নাজিয়াত ফিরলে রাত জেগে কাজ করতেন। সমীরকে সামনে-পেছনে সেই সময় নানা কথা বলেছে মানুষ। বউয়ের টাকায় খাচ্ছে, সারা দিন বাসায় বসে বাচ্চা পালে, বউয়ের আঁচলের নিচে চলে গিয়েছে—শুনতে হয়েছে এ ধরনের অপমানজনক নানা কথা। আর নাজিয়াতের মতো খারাপ মা যেন পৃথিবীতে আর নেই। এই টুকু সন্তানকে ‘ফেলে’ চাকরি করতে যাচ্ছে। কীভাবে স্বামী সারা দিন সন্তান লালন–পালন করে, এসব নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার যেন শেষ ছিল না। সমীর বলেন, এসব কথায় মাঝেমধ্যে যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম না, তা নয়। তবে চেয়েছি নাজিয়াত যেন নিজেই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছায়। ও যেন ওর কাজটা আনন্দের সঙ্গে করতে পারে।

নাজিয়াত জানান, ‘আয়দিন ওর বাবার কাছে থাকে, এটা আমি সব সময় খুব স্ট্রংভাবে বলি। কারণ, আমরাই ওর প্রাথমিক কেয়ারগিভার। বাবা কিংবা মা—সন্তান যেকোনো একজনের কাছে থাকলেই হলো।’

সমীর–নাজিয়াত দম্পতি একমাত্র ছেলে আয়দিনের বয়স এখন সাত বছর

সমীরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্ত্রীর পাশে থাকার এমন প্রত্যয় তিনি কোথা থেকে পেলেন? ‘আমি আসলে আমার রোলটা উল্টো করে ফেলেছি। আমি চেয়েছি একজন পার্টনার হিসেবে আরেকজনের পাশে থাকতে। আমার সন্তানের মায়ের ক্যারিয়ারে কোনো বাধা সৃষ্টি না করতে। হ্যাঁ, কাজটা সহজ ছিল না। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের স্বপ্ন পূরণে তার পাশে থাকতে পারার অনুভূতিটা দারুণ। আমি নিজেকে এটা ভেবে মোটিভেট করেছি যে আমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি তো কি হয়েছে, নাজিয়াতেরটা করছি। এটাই বিরাট পাওয়া।’

সমীরের বৃদ্ধ মা–বাবাও কখনো পুত্রবধূর সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়াননি, সব সময় সব সিদ্ধান্তে পাশে থেকেছেন। একটা চমৎকার সাপোর্ট সিস্টেম ছিল বলেই সহজ হয়েছে তাঁদের পথচলা।

নাজিয়াত জানালেন, আয়দিনের মানসিক বিকাশ বিলম্বিত হয়েছে। এ জন্য সমাজ বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটেছে বলেই সন্তানের বিকাশ বিলম্বিত হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে গিয়ে এমন অনেক শিশুকে তাঁরা দেখেছেন, যাঁদের মায়েরা সন্তানকে শতভাগ সময় দেন।

সমীর বললেন, তাঁর এই গল্পে একজন তরুণও যদি অনুপ্রাণিত হন, একজনও যদি মনে করেন যে স্ত্রীর এগিয়ে যাওয়ার পথে পাশে থাকা জরুরি, তাহলেই নিজেকে সার্থক বলে মনে করব। সমাজের প্রচলিত ট্যাবুগুলো ভেঙে আধুনিক তরুণদের এগিয়ে যাওয়া জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।