রোববার দুপুরে টিএসসিতে যা দেখলাম

৩৭ দিন পর আজ চালু হয়েছে মেট্রোরেল। নারী যাত্রীদের কামরায় ওঠামাত্র কানে এল কথোপকথন। একজন বলছেন, ‘আমি তো গতকাল সারা রাত ছিলাম। ভোরে বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে এখন আবার যাচ্ছি।’ বোঝা গেল কেবল আমারই নয়, ওঁদেরও গন্তব্যও টিএসসি। আমি যাচ্ছি পেশাগত কাজে। ওঁরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ভিড়ের মধ্যে নড়াচড়ার সুযোগ ছিল না খুব বেশি। কারওয়ান বাজার থেকে টিএসসি পৌঁছে গেলাম দ্রুতই। এগিয়ে গিয়ে কথা বলার আর সুযোগ হলো না।

শিশুরাও বাবা–মায়ের হাত ধরে যোগ দিয়েছে ত্রাণ কার্যক্রমে, ছবিতে ৩ বছরের মানহা

কম যায় না জেন আলফাও

এখন জেন-জির জয়-জয়কার। তবে ত্রাণ কার্যক্রমে পিছিয়ে নেই জেন আলফাও। অর্থাৎ জেন জির পরবর্তী প্রজন্ম।

৩ বছর বয়সী মানহার কথাই ধরা যাক। মানহার বড় ভাই ৬ বছর বয়সী মুনাফের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামের মাঠে। তারা এসেছে মায়ের সঙ্গে। এনেছে নিজেদের জামা-কাপড়, ডায়াপার আর গুড়োদুধ। কয়েক হাত ঘুরে এই মানহা-মুনাফের এই উপহারই হয়তো পৌঁছে যাবে বন্যাদুর্গত কোনো শিশুর কাছে।

বন্যার্তদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন সব শ্রেণি পেশা, সব বয়সের মানুষ। প্রতিদিনই মা-বাবার হাত ধরে আসছে শিশুরা। নটিএসসির মূল ফটকের সামনে নেওয়া হচ্ছে নগদ টাকা। প্রতিদিনই গড়ে ১৫/২০টি করে মাটির বা প্লাস্টিকের ব্যাংক জমা হচ্ছে। জমছে মাটির ব্যাংক। কোনো ব্যাংক এ কেবল চকচকে টাকার নোট, কোনটিতে কেবল ১ হাজার টাকার নোট। আবার কিছু ব্যাংক এ কেবল কয়েন!

শিশুরা ত্রাণ হিসেবে দিয়ে গেছে তাঁদের সখের মাটির ব্যাংক, খেলনা, পোশাক ও আরও নানাকিছু

শিশুদের কারও হাতে নিজেদের পোশাক, কারও হাতে খেলনা। অনেকে ‘ত্রাণ’ হিসেবে রেখে গেছে মাটির ব্যাংক। বানভাসিদের একটা বড় অংশ শিশু। তাঁদের জন্য এগিয়ে আসছে অন্য শিশুরা তথা জেন আলফা, যাঁদের জন্ম ২০১০ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে।

চারুকলা অনুষদের ভেতরে মূলত শিশুদের পোশাক নেওয়া হচ্ছে। সেখানে একটি ব্যানারে ‘শিশুর জন্য শিশু’ শিরোনামে খুব সুন্দর একটা বার্তা লেখা। মূল কথাটা এমন—আপনার শিশু সন্তানের জামাকাপড়, ডায়াপার, খাবার, স্যালাইনের পাশাপাশি শিশুটিকেও সঙ্গে আনুন। মা-বাবাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন।

টিএসসি পরিণত হয়েছে ত্রাণের গুদামে

টিএসসি যেন ত্রাণের গুদাম

মূল ফটক পেরিয়ে টিএসসির ভেতরে যেতেই দেখা গেল হাঁটার রাস্তার করিডর ধরে হাজারো বস্তা। গতকালও ২৫টি ট্রাক ভর্তি করে পানি, খাবার, স্যালাইন পাঠানো হয়েছে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে। এভাবে জমা হওয়া ত্রাণ অনেকটাই কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। টিএসসির ওপর চাপ কমাতে কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে জিমনেশিয়ামের মাঠ, চারুকলায়। টিএসসিতে মূলত টাকা, পানি, স্যালাইন আর প্রয়োজনীয় ওষুধ নেওয়া হচ্ছে। খাবার আর পোশাক নেওয়া হচ্ছে শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের মাঠে। এখন পর্যন্ত যত ত্রাণ জমা হয়েছে, সেগুলোরই প্রক্রিয়াকরণ চলছে। ভিন্ন ভিন্ন বস্তায় আছে—পানি, স্যালাইন, মুড়ি, বিস্কুট, স্যানিটারি ন্যাপকিন, কেক, শিশুর খাবার ইত্যাদি।

মাঠ পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা

কী খাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা?

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কথা হলো বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ফাহমিদা ফাইজার সঙ্গে। ৪ দিন ধরে কাজ করছেন তিনি। বললেন, ‘যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাই করছি। কখনো খাবার, কাপড় সংগ্রহ করছি। কখনো সেগুলো প্যাকেজিং করছি। সরবরাহের কাজ করছি। হিসাব করছি। টাকা গুনছি।’

স্বেচ্ছাসেবকেরা কী খাচ্ছেন? ফাইজা বললেন, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার আসছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়কেরা এগুলোর ব্যবস্থা করেছেন। অনেক জায়গা থেকে এমনিতেই খাবার আসছে। মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি, ডিম-খিচুড়ি। এ ছাড়া কেক, বিস্কুট, কলা, পানি, জুস, স্যালাইন—এসব তো আছেই। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করছি। দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি। এই ভালো লাগার সঙ্গে কোন কিছুর তুলনা নেই।’

ক্যাফেটেরিয়ায় চলছে ত্রাণ গুছিয়ে প্যাকেটজাত করার কাজ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, ইডেন মহিলা কলেজের শাহীনূর সুমির কাছে জানতে চাইলাম, প্রতিদিন আনুমানিক কতজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। সুমি বললেন, ‘অগণিত। এভাবে বলা যাবে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকেরাও যোগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছেন। প্রতিদিন এই সংখ্যাটা বাড়ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা সারা ঢাকা শহর থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করে টিএসসিতে জমা দিচ্ছেন। আসলে এখন মানুষ নিজের দেশটাকে অনেক বেশি “ওউন” করছেন। দেশটা এখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নয়। সবাই এখন দুঃসময়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। দেশ গড়ায় অবদান রাখতে চায়।’

শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের মাঠের গ্যালারিতে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা

প্রয়োজন অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম

টিএসসির দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসকদের একটা দল কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। চলছে বন্যাদুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছানোর কার্যক্রম। ডা. ফাইমুনা আক্তার জানান, তাঁরা স্যাভলন, ডেটল, পানি, স্যালাইন, প্যাড, ডায়াপার, প্যারাসিটামল, অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ, মেট্রোনিডাজল, গ্যাসের ওষুধ, সাধারণ জ্বর, ডায়রিয়া, ঠান্ডা-কাশির ওষুধ, ইত্যাদি পৌঁছে দিচ্ছেন। তবে দুর্গত এলাকায় এখনো ত্বকের বিভিন্ন রোগ ও অ্যালার্জিজনিত রোগে ব্যবহার্য ওষুধ, গজ-তুলা, প্রেশার মাপার যন্ত্র, প্রাথমিক চিকিৎসার নানা যন্ত্রপাতি তথা চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়ে গেছে।

টিএসসির দোতলায় কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশে চলছে ওষুধপত্র গোছানোর কাজ

স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বানভাসি মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা পর্যন্ত তাঁরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। টিএসসি থেকে প্রতিদিন ট্রাক যাচ্ছে দুর্গত এলাকায়। সেখানে প্রশাসন এসব গ্রহণ করে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা আবার পৌঁছে দিচ্ছেন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যা কবলিত এলাকার মানুষদের কাছে।