'সেতু' আর 'লাইভ' নিয়ে আছেন যে ব্যারিস্টার

প্রথম যখন একটি কাঠের সেতু বানালেন, কানাঘুষা শুরু হলো—এ আবার কোন নাটক! কেউ কেউ এটাকে একধরনের ‘পাগলামো’ বলে ঠাওরালেন। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আরকি। কেউ কেউ আবার ভাবলেন, নির্বাচনে দাঁড়ানোর ধান্দা। কিন্তু এসব কথায় কান না দিয়ে একে একে ২১টি কাঠের সেতু বানালেন তিনি। এবার সবার ভুল ভাঙল। না, মানুষটা ঠিকই কাজের। 

এবার তিনি পারিপার্শ্বিক সমস্যাগুলো লাইভ করতে লাগলেন ফেসবুকে। পাওয়া গেল কর্তৃপক্ষের আশাব্যঞ্জক সাড়া। এভাবে আজ তিনি হাজারো মানুষের প্রিয় একজন। তিনি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। হাইকোর্টের আইনজীবী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জনস্বার্থে বেশ কিছু রিটের জন্যও তিনি আলোচনায় এসেছেন। এর মধ্যে একটি হলো গণমাধ্যমে কিশোর আদালতে বিচারাধীন কোনো শিশুর নাম–পরিচয় প্রকাশ না করাবিষয়ক রিট।
বুধবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আলাপে বসেই ফেসবুক খুলে সৈয়দ সায়েদুল হক জানিয়ে দিলেন, এখানে আসার মাত্র চার ঘণ্টা আগে দেওয়া একটি লাইভে ভিউ সাড়ে ৫ লাখ, ২১ হাজার শেয়ার, লাইক ৪৯ হাজার এবং সাড়ে ৫ হাজার মানুষ মন্তব্য করেছেন। লাইভের বিষয় ছিল—রাজধানীর নবাবপুরে একটি ট্রান্সফরমারের পাশে অসংখ্য তার পেঁচিয়ে আছে। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে...।

২১ টি কাঠের সেতু বানিয়েছেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ছবি: ফেসবুক

সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, ‘সরকারি সাহায্য পৌঁছে না—এমন এলাকায় নিজের টাকায় যখন কাঠের ব্রিজ তৈরি শুরু করলাম, তখন অনেকে বলতেন, ব্যারিস্টার তো দেখি নাটক শুরু করছে! কেউ বলতেন পাগলামি করছি। কেউ কেউ ভাবতেন নির্বাচনে দাঁড়াব, নেতা হতে চাই। তবে নিজে উপস্থিত থেকে নিজের টাকায় যখন ২১টি ব্রিজ তৈরি করলাম, তখন অনেকেই ভাবতে শুরু করলেন, আসলেই আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। তারপর আস্তে আস্তে ফেসবুকে চারপাশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লাইভ দিতে শুরু করি। এখন আর আমাকে নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয় না, প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেই স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো লাইভে ভিউজের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শেয়ার হচ্ছে লাখ লাখ। লাখ লাখ মানুষ মন্তব্য করছেন।’
চারপাশের সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত ফেসবুকে লাইভ দেওয়ার কারণে তাঁর আইনজীবী পরিচিতির চেয়েও মানবাধিকারকর্মী বা মানুষের বন্ধু হিসেবে পরিচিতি বেড়েছে। অনেকে তাঁর আড়ালে বা সামনেই ‘পাগল’ বলেও ডাকেন। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি অভিনব উপায়ে মানুষের জন্য কাজ করছেন।

বিভিন্ন ঘটনার লাইভ করেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ছবি: ফেসবুক

কিন্তু এভাবে লাইভ করে কয়টি সমস্যার সমাধান করবেন—এ প্রশ্নের উত্তরে সায়েদুল হক বলেন, ‘লাইভ করে আমি শুধু সমস্যাটা তুলে ধরি। কিছু সমাধানের কথা বলি। সমস্যার সমাধান আমি করতে পারব না। মানুষ এবং কর্তৃপক্ষের মগজে মেসেজটি দিতে চাই। কেননা আমি জানি, আমার লাইভের পর সড়কের মাঝখান থেকে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি সরলে বাংলাদেশ পাল্টাবে না। আমার শক্তি কোটি দর্শক। আমার ভিডিও লাখ লাখ মানুষ শেয়ার করছেন, মানে তাঁরাও পরিবর্তন চান। আর মানুষের সমর্থনের পর কর্তৃপক্ষও একটু নড়েচড়ে বসে। এই সব কাজে এখন আর আমাকে পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হচ্ছে না।’
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের ছেলে সায়েদুল হক। নিজের উপজেলায়, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে আইনজীবী পেশায় আছেন। উপজেলার নিজের স্কুলে গিয়েও একটি লাইভ করেন। এই স্কুলের যে শিক্ষার্থী ব্যারিস্টার হবেন, তাঁকে একটি গাড়ি কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লাইভে। পরবর্তী ব্যারিস্টার পেতে কমপক্ষে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এই লাইভটি ভাইরাল হয়।
সায়েদুল হকের এ পর্যন্ত ভাইরাল হওয়া কয়েকটি লাইভের খবর তিনি জানালেন। হবিগঞ্জে চা–বাগানের ভেতরে একটি ডাকাতির ঘটনায় তিনি লাইভে গিয়ে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য এবং একই সময়ে লাইভে দর্শকদের সামনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এনে হাজির করেন। ওসি বলার চেষ্টা করেন, তিনি নিরাপত্তা টহলের ব্যবস্থা করেছেন। তবে লাইভেই ভুক্তভোগীরা ওসির কথার প্রতিবাদ করতে থাকেন।
ফেসবুক লাইভে যে কাজ হয়, এর উদাহরণও দিলেন সায়েদুল হক। রাজধানীর বাবুবাজার সেতুর বাতি ছিল না, লাইভের তিন দিনের মাথায় বাতি লাগানো হয়। নরসিংদীতে লাইভের ছয় ঘণ্টার মধ্যে সড়কের মাঝখান থেকে বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণ করে কর্তৃপক্ষ। শুধু তা–ই নয়, সায়েদুল হক জনস্বার্থে রিট মামলা করলে হাইকোর্ট দেশের ঝুঁকিপূর্ণ সব খুঁটি অপসারণের নির্দেশ দেন।
নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদী পর্যন্ত সড়ক বিভাজকে কোনো সাইনবোর্ড ছিল না, চালকেরা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন। এক দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়।
রাজধানীর কাঁটাবনে বিদ্যুৎ অফিসের সামনে বালু ফেলে ফুটপাত বন্ধ করা ছিল। এর পাশেই ছিল বড় ডাস্টবিন। লাইভের পর কম সময়ের মধ্যেই তা উধাও।

ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ছবি: ফেসবুক

গুলিস্তানের শুরিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ডাস্টবিন ছিল। স্কুলের ১ হাজার ৫০০ বাচ্চার মুখের সামনে ছিল এটি। তবে লাইভের পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা অপসারণ করা হয়। ময়লার ডাস্টবিনের ভেতরে দাঁড়িয়ে লাইভ করেছিলেন সায়েদুল হক।
সমস্যা সমাধানের পর সায়েদুল হক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য আবার ঠিক ওই জায়গায় গিয়ে লাইভে হাজির হন। এতে মানুষের মধ্যে একধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে ‘পাগলামি’ করেও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
সায়েদুল হকের স্ত্রী শাম্মী আখতার নিজেও আইনজীবী। তবে বর্তমানে ঘরেই সন্তানদের সময় দিচ্ছেন। এই দম্পতির চার বছর বয়সী ছেলে ও ছয় বছর বয়সী মেয়ে আছে। সায়েদুল হক এই ফেসবুক লাইভ, মানুষের জন্য কাজে সময় বেশি দেন বলে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হন। তবে মেনেও নিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
সায়েদুল হকের কথা, ‘আমাকে এ ধরনের কাজ করতে কেউ বাধ্য করছে না। আমিও স্বার্থপর হয়ে যেতে পারি। কাজ করার ইচ্ছা না–ও থাকতে পারে। তাই যত দিন পারি, তত দিন এই কাজ করব। আর পৈতৃক সূত্রেই আমাদের পরিবারের সম্পত্তি একেবারে কম না। আমার বাবা মারা গেছেন। মা আমেরিকায় বোনদের কাছে থাকেন। তবে মাকে বলা আছে, আমি বিপদে পড়লে তিনি আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের দেখবেন। আমরা চার বোন, দুই ভাই। আমার বিশ্বাস, ভাইবোনেরাও এগিয়ে আসবেন।’
সায়েদুল হক নিজের কাজের পাশাপাশি যেখানেই সমস্যা দেখেন, সেখানেই লাইভ করার জন্য থামেন। আর প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়ি যান। সেখানেও তাঁর কাজের অন্ত নেই। স্কুলের বাচ্চাদের ফুটবল কিনে দেওয়া, ল্যাপটপ দেওয়া, টিউবওয়েল বসানো চলছেই। এ ছাড়া এই ব্যারিস্টার সায়েদুল হক উপজেলায় ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, উপজেলার কোনো ছেলেমেয়ের যাতে শুধু টাকার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ না হয়। শিক্ষার যে স্তরই হোক সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
সায়েদুল হকের মতে, ‘কে কী কাজ করবেন বা এ কাজ কার করার কথা ছিল—এসব ভেবে সময় নষ্ট করি না। আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে উদাহরণ তৈরি করতে চাই। বসে না থেকে কাজ করে যেতে চাই। আমি নিজের জন্য সঞ্চয় করতে পারিনি। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের মালিক হইনি। ফ্ল্যাটে না ঘুমিয়ে মারা গেলে কী এমন ক্ষতি হবে? ’
তরুণদের নিয়ে ৪০ বছর বয়সী সায়েদুল হকের অনেক স্বপ্ন। তিনি বলেন, তরুণদের মনে রাখতে হবে সমাজসেবা করতে হলে সর্বস্ব দিয়েই করতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করতে হলে বড় কলিজা লাগে। আর নেতা মানে নিজের পকেট ভরা না। সংগ্রামের ভাষণ দিয়ে নিজে ধনী হওয়া না। পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এ ধরনের রোল মডেল তৈরি করতে পারলে তরুণেরা আর বিপথে যাবে না।
সায়েদুল হক রীতিমতো ‘সেলিব্রেটি’ হয়ে গেছেন। প্রথম আলোয় আসার পর থেকে প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরা এসে তাঁর সঙ্গে একটি সেলফি তোলার জন্য আবদার করেন। কেউ কেউ ফোন নম্বর নিয়ে যান। সায়েদুল হক হাসিমুখেই সবার আবদার পূরণ করছিলেন।