কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী নিয়ে বেকায়দায় আছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে ঘরের প্রার্থীকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দলটিকে। উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বহিষ্কারের হুঁশিয়ারি দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাঁরা সমানে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
কুতুবদিয়া: কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় ছয়টি ইউনিয়ন পরিষদ—উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ, লেমশিখালী ও আলী আকবর ডেইলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২২ মার্চ। এর মধ্যে উপজেলার উত্তর ধুরুং, কৈয়ারবিল ও বড়ঘোপ ইউনিয়নে তিন বিদ্রোহী নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নৌকা প্রতীকের তিন মাঝি।
উত্তর ধুরুং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াহিয়া খান। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন সিরাজদ্দৌল্লাহ (আনারস)। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ–বিষয়ক সম্পাদক এবং এই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান।
ইয়াহিয়া খান জানান, দলের বিদ্রোহী সিরাজদ্দৌল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
সিরাজদ্দৌল্লাহ জানান, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এলাকার ভোটাররা তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। এতে অনেকে ভীত হয়ে নানা ষড়যন্ত্র করছেন।
এই ইউনিয়নে আরও তিনজন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। তাঁরা হলেন, নেজাম উদ্দিন (ধানের শীষ), আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী (মোটরসাইকেল) ও আজিজ মো. শাহ নিয়াজ (চশমা)।
কৈয়ারবিল ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মো. আজমগীর। তিনি ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।
কিন্তু দলের ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে মাঠে নেমেছেন ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী (ঘোড়া)।
মনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী জানান, নৌকা প্রতীকের জন্য তিনি এ পর্যন্ত কোনো তদবির করেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি মাঠে নেমেছেন ভোটারদের চাপে। তাই ভোটের দিন পর্যন্ত তিনি লড়ে যাবেন।
এই ইউনিয়নে আরও দুজন শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন সাবেক চেয়ারম্যান জালাল আহমদ (ধানের শীষ) ও মো. আবু মুছা কুতুবী (আনারস)।
বড়ঘোপ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন। তিনি এই ইউনিয়নেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য ছাবের আহমদ (আনারস)। এ ইউনিয়নে রয়েছে আরও তিনজন প্রার্থী। তাঁরা হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান শাকের উল্লাহ (মোটরসাইকেল), মো. মোবারক হোছাইন (ধানের শীষ) ও মিজানুর রহমান (ঘোড়া)।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা, বিএনপি ও জামায়াত অধ্যুষিত এসব ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতব্বর বলেন, দলের তিন বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে ৪ মার্চ উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
দলের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুচ্ছফা বলেন, ‘উপজেলার সব কটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের জয়লাভ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি। কিন্তু বিদ্রোহী নিয়ে বিপাকে আছি।’
পেকুয়া: কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে চারটিতে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী রয়েছে। আরেকটি ইউপিতে একজন সাবেক চেয়ারম্যান দল বদল করে আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন।
তবে ভোটাররা বলছেন, ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দিতে পারেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও স্থানীয়ভাবে নানা বিষয় বিবেচনা করবেন ভোটাররা।
অবশ্য বিদ্রোহীরা নিজেদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাদের আশা, বিদ্রোহী প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকবেন না। তাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেবেন।
জানতে চাইলে পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা কয়েকবার বৈঠক করেছি। তাঁদের দলীয় প্রার্থীর বাইরে প্রার্থী না হতে বলা হয়েছে। এরপরও যদি কোনো নেতা-কর্মী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে বহাল থাকেন, তাহলে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে তাঁদের বহিষ্কারের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
পেকুয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ৩১ মার্চ দ্বিতীয় দফায় পেকুয়া উপজেলার সাত ইউপিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ১৩ মার্চ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৪ মার্চ প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে।
দলের নেতা-কর্মীরা বলেন, টৈটং ইউপিতে নৌকা প্রতীক তুলে দেওয়া হয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ। তিনি রাত-দিন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, তাঁর জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায়। তাঁর হয়রানি থেকে আমিসহ দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত বাদ যাননি। এ কারণে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের চাপে প্রার্থী হয়েছি।’
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি কাউকে হয়রানি করিনি। ধরলে পুলিশ ধরেছে।’
উজানটিয়া ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এম শহিদুল ইসলাম চৌধুরী। কিন্তু এ ইউপিতে গত নির্বাচনে মাত্র ১৬০ ভোটে হেরে যাওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল করিম এবারও প্রার্থী হয়েছেন। এতে নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
তোফাজ্জল করিম বলেন, ‘প্রার্থী হতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাপ রয়েছে। সাধারণ ভোটাররাও আমার সঙ্গে আছেন। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস—সবকিছুতেই মানুষের পাশে থেকেছি। সবকিছু বিবেচনা করে প্রার্থী হয়েছি।’
একইভাবে পেকুয়া সদর ইউপিতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছেন পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম। এখানে দল মনোনয়ন দিয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক সম্পাদক কামাল হোসেনকে। রাজাখালী ইউপিতে নৌকার মাঝি নির্ধারিত হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজমগীর চৌধুরী। এ ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক ছৈয়দ নুর। গত নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন।
মগনামা ইউপিতে ভোটের মাঠে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মো. ইউনুছ চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হয়েছেন। এ ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি খাইরুল এনাম।
ইউনুছ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ তাঁর প্রতি অবিচার করেছে। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকে তাহলে তাঁর বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।