ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে বাদাম বিক্রি করব। আকাশে রং-বেরঙের ঘুড়ি দেখে কত যে দুপুর পার করেছি তার কোনো ঠিক নেই। স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় বারবার জানালা দিয়ে দেখতাম, কখন আমার বন্ধুরা মাঠে খেলতে আসে। বন্ধুদের দেখামাত্র তাড়াহুড়া করে পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে বের হয়ে যেতাম খেলতে। স্কুলের বইয়ের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
এসব দেখেশুনে বাবা-মা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা একপর্যায়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে আমি এখন কাজ করছি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইম-এর প্রধান কার্যালয়ে, সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে। আমি এবং টাইম ইনক-এর আরও দুজন ডিজাইনার মিলে টাইম ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইট time.com নতুন করে ডিজাইন করছি। আমরা আশা করছি, এ বছরের কোনো এক সময়ে time.com, money.com, fortune.com, time4kids.com নতুন ওয়েবসাইটের কাজ শেষ করতে পারব। আমি এখানে কাজ করে অনেক খুশি। পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন এই সব ওয়েবসাইটে আসে, নিজেরা পড়ে এবং অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে।
বাবা-মায়ের স্বপ্ন, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে কোনো সরকারি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিলেন, যতটুকু সঞ্চয় আছে তা দিয়ে ছেলেকে প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়াবেন। আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না। বাবা-মাকে বললাম, আমার পক্ষে কোনোভাবেই ডাক্তারি পড়া সম্ভব না। তখন বিবিএ আর কম্পিউটার সায়েন্সের একটা চল ছিল। সবাই কেন যেন এ দুটি বিষয়েই আগ্রহী ছিল। আমি বাবা-মাকে বললাম, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ব। তখন আমার খালাতো ভাইয়ের বাসায় একটা কম্পিউটার ছিল, যা সবাই ব্যবহার করত। আমি অপেক্ষায় থাকতাম, কখন সবাই ঘুমাতে যাবে, যাতে আমি একাই কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারি।
আমি সারা রাত কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতাম। রাতের পর রাত। আমার বাবা-মা ও খালাতো ভাইয়েরা মিলে ঠিক করলেন যে কম্পিউটার সায়েন্স আমার জন্য ঠিক। তাঁরা দেখতেন আমি সারাক্ষণ কম্পিউটারে বসে থাকি। কিন্তু তাঁরা জানতেন না যে আমি শুধু এডোবি ফটোশপ, ফ্ল্যাশ ও প্রিমিয়ার নিয়ে বসে থাকতাম। কোনো ধারণা ছাড়াই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হয়ে গেলাম এবং যথারীতি পরীক্ষায় খারাপ করতে থাকলাম।
কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকা, সেই সঙ্গে যোগ হলো ফটোগ্রাফি। অন্যের ছবি নিয়ে এডিটিং আর অ্যানিমেশন করার চেয়ে নিজের তোলা ছবি নিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগত। এরপর সামান্য HTML এবং অ্যানিমেশন নিয়ে ওয়েবসাইট বানানো শুরু করলাম। আমার এ কাজ বিজয় অনলাইনের মার্কেটিং ডিরেক্টরের চোখে পড়ে যায় এবং সেখানে আমি পার্টটাইম ওয়েব ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর আমি ডাইভার্সিটি ভিসা (ডিভি) পাই এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউইয়র্কে চলে আসি। সঙ্গে নিয়ে আসি কম্পিউটার সায়েন্স, ফটোগ্রাফি ও তিন বছর ওয়েব ডিজাইন করার অভিজ্ঞতা।
নিউইয়র্কে আসার পর প্রথম কয়েক বছর আমার জন্য সফল ছিল না। এখানের অনেক বাংলাদেশি গ্র্যাজুয়েট আমাকে চাকরি খুঁজে দেয় রেস্টুরেন্টে অথবা বলে ট্যাক্সি চালাতে। তাঁদের কথা না শুনে আমি ব্রুকলিনে এক বাংলাদেশির দোকানে কাজ নিই। আমি সেখানে প্রিন্ট ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন ও কম্পিউটার শেখানো থেকে শুরু করে আরও বিভিন্ন কাজ করতাম।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যানহাটনে চাকরি খুঁজতে থাকি। অবশেষে একটি প্রিন্টিং কোম্পানিতে ডিজাইনার ও ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করি। যখন বুঝতে পারি এ কাজে বেশি দূর আগানো যাবে না, তখন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ওয়েব ডিজাইনার বা অ্যানিমেটর হিসেবে শিক্ষানবিশী শুরু করি। ছয় মাস বিনা বেতনে চাকরি করার পর ওই কোম্পানিতেই ফুলটাইম চাকরি পাই। এরপর নিউইয়র্ক পোস্ট-এ কাজ পেয়ে যাই।
দুই বছর সেখানে কাজ করি। এর মধ্যে NYPost.com ও PageSix.com রিডিজাইন শেষ হয়। এরপর নিজেকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নতুন চাকরি খোঁজা শুরু করি। ফেসবুকে আমার বন্ধুর একটা পোস্টে দেখি টাইম ইনক ডিজাইনার খুঁজছে। আমি তখন চাকরির জন্য আবেদন করি এবং চাকরি পেয়ে যাই।
আমার সব সময়ের লক্ষ্য ছিল, আমি যে কাজ করতে ভালোবাসি সে কাজই করব। অনেক বাধার মধ্যেও আমি আমার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই যখন চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে, তখন আমি ক্লায়েন্টকে কি ডিজাইন দিয়ে খুশি করব, তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কত পারিবারিক অনুষ্ঠান যে বাদ দিয়েছি, তার কোনো সীমা নেই। আমি টিভি দেখি না। মনে হয় টিভি না দেখে ওই সময়টায় কিছু শিখলে, করলে অথবা ঘুমালেও ভালো। সাফল্যের সঙ্গে ত্যাগের একটা সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি।
২০১৬ সালে বাবা-মা নিউইয়র্কে আসেন। আমি তাঁদের টাইম ম্যাগাজিনের অফিস ঘুরে দেখাই। বাবার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর মায়ের অবাক হওয়া আমার ভালো লাগে। এখনো আমি মনে করি, বাদাম বিক্রির আইডিয়াটা খারাপ ছিল না। সারা বিশ্বে বাদামের অনেক চাহিদা।