ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় অনেকেই আদালতের রায় লিখেছেন। কিন্তু গত আট বছরে বাংলায় ৮ হাজার রায় ও আদেশ লিখে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন। বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের ৯২ জন বিচারপতির মধ্যে তিনিই ব্যতিক্রম।
২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে শপথ নেন শেখ মো. জাকির হোসেন। এর আগে যখন তিনি আইনজীবী, তখন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা বই পড়ে সংকল্প স্থির করেন। তিনি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই থেকেই জানতে পারেন, ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপর বাংলা চালু হবে, সে হবে না।’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা নিয়েই সর্বস্তরে বাংলা চালু করে দেব। ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ টুঙ্গিপাড়ার সন্তান বিচারপতি শেখ জাকির হোসেন বিচারক হয়েই নিজে বাংলা চালু করেন, পণ্ডিতেরা পাছে কী বলবেন, তার অপেক্ষা করেননি।
হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে দুই বছর কাজ করার পর স্থায়ী মানে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি করা হয়। তাই একটা ঝুঁকি ছিলই। কারণ, ওই সময় ১৫ থেকে ২০টি রায় প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিতে হয়। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই প্রথম বিচারক, যিনি বাংলায় লেখা ১৫টি (৬টি ফৌজদারি, ৬টি রিট ও ৩টি দেওয়ানি) রায় জমা দিয়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
তাঁর আগে যেমন তেমনি পরে আরও কেউ কেউ এগিয়ে এসেছেন বাংলায় রায় লেখায়। হাইকোর্টের বেঞ্চ সাধারণত দুজন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত হয়। নবাগতদের একটা লম্বা সময় দ্বৈত বেঞ্চের কনিষ্ঠ হিসেবে সাধারণত জ্যেষ্ঠকে অনুসরণ করাই রেওয়াজ। তিনি ভাগ্যবান। কারণ, জ্যেষ্ঠরা ইংরেজি লিখিয়ে হলেও বাংলায় তাঁর রায় বা আদেশ লেখাকে তাঁরা উৎসাহই জুগিয়েছেন। তিনি প্রথম জ্যেষ্ঠ বিচারক হিসেবে পান বিচারপতি আনোয়ারুল হককে। তিনি ছুটিতে গেলে এক সপ্তাহে পাঁচটি রায় লিখেছিলেন। দেওয়ানি রায় দানে তাঁকে বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী হাতিরঝিলে বিজিএমইএর অবৈধ ভবন অপসারণ–সংক্রান্ত মামলার অথর জাজ (মূল রায় দানকারী)। কিন্তু কনিষ্ঠ হিসেবে তাঁকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভবনটির ভূমির আইনি ইতিহাসের সুলুক সন্ধানে। তিনি তাই করেন, কিন্তু মূল রায়টি লেখা হয়েছিল ইংরেজিতে। রায়ের গর্ভে দেখা যাবে, কিছু অংশ বাংলায় লেখা। রায়ে যদিও তথ্যটি বলা নেই, কিন্তু বাংলায় লেখা অংশটি তাঁরই।
আইনি পরিভাষা ও যথাশব্দের ঘাটতি এখনো প্রকট। তাই ইংরেজির চেয়ে বাংলায় রায় লিখতে সময় দ্বিগুণ লাগার বিষয়টি হাড়ে হাড়ে টের পেলেও দমে যাননি শেখ মো. জাকির হোসেন। শ্বেতশুভ্র সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি ইটপাথরও এখন অভ্যস্ত ইংরেজিতেই। বাংলা শর্টহ্যান্ডে ডিকটেশন নেওয়া ও টাইপ করার মতো লোকবলের ঘাটতি তাঁকে অহর্নিশ পীড়া দেয়। আদালতের প্রশাসনিক পরিমণ্ডল ‘রাষ্ট্রভাষা’ বাংলাবান্ধব নয়। তার একটা প্রমাণ, অনেকের মতে বাংলায় অভ্যস্ত তাঁর সহকারীর পদোন্নতি লাভে দীর্ঘসূত্রতা।
বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন আদালতে উচ্চারিত রায় টেপে ধারণ করে পরে টাইপ করাতেন। গত অক্টোবর থেকে দেখা যায়, এজলাসেই তাঁর ডিকটেশনে কম্পিউটারে সরাসরি লেখা চলছে। বানানরীতি নিয়ে ফাঁপরে পড়ারই কথা, তবে কারও মাথায় ‘বারি’ দেওয়া আর কাউকে ‘বাড়ি’ দেওয়ার মতো বানান যদি অর্থগত হেরফের না ঘটায়, তাহলে তিনি ই–কার বা ঈ–কার নিয়ে পেরেশান হতে নারাজ।
তবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন আরও উদ্যোগী না হলে ভাষাগত ও বানানবিভ্রাটের সমস্যা কারও একক চেষ্টায় মোকাবিলা করা অসম্ভব। কিছু রায় পর্যালোচনায় দেখা যায়, মুদ্রণ ভুল কম নয়। শুদ্ধভাবে রায় প্রকাশনার জন্য উপযুক্ত লোকবলের বিকল্প নেই। ২০০৩ সালে চাঁদপুরে নাসরীন-১ লঞ্চ ডুবলে ১১০ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এই মামলায় ১৩৩ পৃষ্ঠার রায়টি তিনি বাংলায় লেখেন। কিন্তু মুদ্রণ ভুলে ‘সারবত্তা’ ছাপা হয়েছে ‘সারবর্তা’। অভিধানে ‘সারবর্তা’ বলে কোনো শব্দই নেই। দক্ষ লোকবল না থাকায় সার্বিকভাবে আদালতের মুদ্রিত আদেশ, দলিল-দস্তাবেজে ইংরেজির চেয়ে বাংলা বানানে ভুলের মাত্রা বেশি। এ অবস্থার উন্নয়নে আদালত প্রশাসনে তেমন কোনো প্রয়াস নেই। আদালতে প্রমিত বাংলার প্রসার ঘটানোর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কোনো বিশেষ কর্মসূচি নেওয়ারও উদ্যোগ নেই। সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে প্রতিদিন সবার মূল আকর্ষণ হলো কজলিস্ট (বলা চলে আদালতের দৈনিক সংবাদপত্র)। প্রতি কার্যদিবসে ৩০০ থেকে ৬০০ পৃষ্ঠা ছাপা হয়। যুগের পর যুগ এটি ছাপা হয়েছে পুরোপুরি বাংলায়। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে শুধু বিচারপতিদের নাম ও তাঁদের কার্যক্রমসংক্রান্ত অংশ (১৫/১৬ পৃষ্ঠা) ছাড়া বাদী-বিবাদী ও আইনজীবীদের নাম ছাপা হয় ইংরেজিতে। বিজি প্রেস কাজটা করে।
গত বছরের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো শেখ মো. জাকির হোসেনকে অবকাশকালীন বেঞ্চে রিট মোশনে দেখা যায়। এ সময় কারও হয়তো ভ্রু কুচকে যেতে পারত এই ভেবে যে বাংলায় রিটের পরিভাষার ব্যবহার অধিকতর জটিল। কিন্তু তাতেও উতরে গেছেন তিনি। কোয়াশমেন্ট মানে অবমোচন, বেনিফিট অব ডাউট সন্দেহের অবকাশ বদলে করেছেন ‘সন্দেহের সুবিধা’, নন–স্পিকিং অর্ডার–কে করেছেন ‘অব্যাখ্যাত’। এটা বেশ একটি বদ্ধমূল ধারণা যে ইংরেজি থেকে বাংলা করলে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় হারিয়ে যায়। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন অবশ্য এ ধরনের যুক্তি নাকচ করেন। কারণ, তিনি জানেন ইংরেজি আইনের আজ যে বাহাদুরি, সেটা কম মেকি নয়। কারণ, রোমান ও লাতিন আইনের পরিভাষাগুলো দেদার ঋণ করেই ইংরেজি ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাতেও এমন বয়ান আছে, যা ইংরেজি করলে কিছুটা হারিয়ে যায়।
কাজল রেখাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত স্বামীকে ২০১১ সালে তিনি বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভিকটিমকে কাদাপানিযুক্ত ইরি ধান কাটা ক্ষেতের মধ্যে শ্বাসরোধ করিয়া হত্যা করা হইয়াছে বলিয়া সাক্ষীদের সন্দেহ কিন্তু এক নম্বর সাক্ষীর সঙ্গে যখন আপিলকারীর শেষ দেখা হয়, তখন তাহার পোশাক-আশাক বা শরীরে কাদা মাটির চিহ্ন বা পোশাক-আশাক পানিতে ভিজা থাকা স্বাভাবিক। সাক্ষ্য প্রমাণে এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।’ কোনো সন্দেহ নেই, আদালতে বাংলা প্রচলনে সবাই এগিয়ে এলে পরিভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকবে।
৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ৩০ লাখের বেশি মামলা জটে জেরবার। কেন বাংলায় রায় দেব, এর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন। ‘জুয়েল শিকদার বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় বরিশাল শহরের জুয়েল শিকদারের কাছ থেকে ২০০৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশ ৫০ বোতল ভারতীয় ফেনসিডিল উদ্ধার করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তিনি তিন বছর দণ্ডিত হন। ২০১০ সালে এই রায় খারিজে তিনি হাইকোর্টে আসেন।
বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ওই দণ্ড বহাল রেখে ২০১১ সালের ২৬ মে লিখেছেন, ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া উৎকৃষ্ট রায়টি যদি দরখাস্তকারীর বোধগম্য ভাষায় প্রদত্ত হইত, তাহা হইলে দরখাস্তকারীকে হাইকার্ট দেখিতে হইত না বা তাহাকে কেহ হাইকোর্ট দেখানোর দুঃসাহস করিত না, দরখাস্তকারীর বোধগম্য ভাষায় এটি প্রচারিত হইলে তাহার তথ্য-উপাত্ত, পরিশেষে উপসংহারে প্রদত্ত সাজা কেন তাঁকে প্রদান করা হইয়াছে, তিনি কি সত্যিই দোষী? উক্ত সাজা ঠিক কি বেঠিক? তাহা উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইতেন। সে ক্ষেত্রে হয়তোবা দরখাস্তকারী এই অধিক্ষেত্রে সাজা বাতিলের আবেদন করিতেন না বা হাইকোর্টে আসিতেন না এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এই এত “তথ্য সমৃদ্ধ বস্তুনিষ্ঠ উৎকৃষ্ট” রায়টি বিচারপ্রার্থীর নিকট সত্যই মূল্যায়িত হইত।’
মাতৃভাষায় রায় লেখা হলে যে সুবিধাই বেশি, তা সহজেই বোঝা যায়। বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন যে পথ দেখাচ্ছেন, সে পথ অনুসরণের গতি এখনও মন্থর। আশা করব, ভবিষ্যতে বাংলায় লেখা রায় ও আদেশ আরও বেশি দেখা যাবে।