২০১৬-এর প্রায় শেষ প্রান্তে আমরা চলে এসেছি। নারী বিষয়ে এ বছরে আছে যেমন ইতিবাচক খবর, তেমনি নেতিবাচক। নারীর অর্জনের পাশাপাশি আছে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের খবর। বছরজুড়েই ছিল মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। পাশাপাশি ছিল বাল্যবিবাহ ঠেকানোর সাহসী কাহিনি। এক বছরের নারী বিষয়ে সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ রইল এক নজরে।
বিয়ের বয়স ১৬ নাকি ১৮!
বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ হবে কি না—এ বিষয়ে ২০১৫ সাল থেকে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। পরে সরকার নতুন কৌশল অনুসরণ করে। সেটি নিয়ে এ বছরেও তর্কবিতর্ক চলে। অবশেষে ২৪ নভেম্বর ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর যে খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তাতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই রাখা হয়েছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে হতে পারবে। বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রসঙ্গটি ১৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়। তবে এই ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ ১৮-এর নিচে কত বছর বয়সে বিয়ে হতে পারে, আইনে তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশটি পুনর্বিন্যাস ও বাংলায় রূপান্তর করে ওই আইনে বিভিন্ন অপরাধের আওতা ও সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এই আইনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদ বা সমমানের পরীক্ষার সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট—এগুলোর যেকোনো একটি বিয়ের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হবে।
বাল্যবিবাহের সাজার মেয়াদ বাড়ানো হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ১৮-এর নিচে বিয়ে হতে পারে—এ বিষয়ে চিন্তিত বিশেষজ্ঞরা। জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা মনে করেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। বিয়ে একটা মেয়ের জীবনের সব কিছু না। গ্রামাঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে অভিভাবকেরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। বিশেষ ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিতে পারবেন—সেটির সুযোগ অনেকে নিতে পারেন। আইন থাকলেও আইনের ফাঁকও খুঁজে বের করেন অনেকে।
তবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে। ২০১৫ সালে ঝালকাঠির শারমিন সাহসিকতার সঙ্গে তার বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছিল। এ বছরও এমন ঘটনা রয়েছে। পাবানর ঈশ্বরদীতে তাসলিমা নিজের বাল্যবিবাহে রাজি হয়নি। ২০ নভেম্বর সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার মধ্যনগর পাবলিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মিতু মালাকারের (১৪) বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে তার সহপাঠীরা।
বছর জুড়েই হত্যা, ধর্ষণ, হত্যার চেষ্টা
হত্যা, ধর্ষণের খবর সারা বছরই দেখা গেছে গণমাধ্যমে। সবচেয়ে আলোচিত ছিল সোহাগী জাহান তনুর হত্যার ঘটনা। ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় রাত সাড়ে ১১টায় কালভার্টের পাশেই ঝোপের মধ্যে তনুর লাশ পাওয়া যায়। দুই দফায় ময়নাতদন্ত করা হয় তনুর লাশের। প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তনুকে হত্যা ও ধর্ষণের আলামত না থাকায় সমালোচনার মুখে পড়ে ফরেনসিক বিভাগ। ১৬ মে তনুর কাপড়ে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যাওয়ার খবর প্রকাশ করেন সিআইডির কুমিল্লা অঞ্চলের তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার নাজমুল করিম খান। তখন আবার গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে তনুর খবর। ১২ জুন দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনেও তনুকে হত্যা ও ধর্ষণের আলামত না থাকার কথা বলা হয়। তবে এত মাস পার হলেও মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। তনুর পরিবার মেয়ে হত্যার বিচার চান। সোহাগী জাহান তনুর হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয় ঢাকাসহ সারা দেশের মানুষ। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানান সব বয়সের ও শ্রেণিপেশার মানুষ।
এ বছরই সিলেটে খাদিজাকে হত্যাচেষ্টা মানুষকে আবার আলোড়িত করে। ৩ অক্টোবর বিকেলে এমসি কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে বিএ (পাস) পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার সময় খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন বদরুল। ঘটনার পরপরই জনতা ধাওয়া করে বদরুলকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন। ঘটনার এক মাস পাঁচ দিনের মাথায় পুলিশ গত ৮ নভেম্বর অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করে। ১৫ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্রের শুনানি শেষে তা গ্রহণ করা হয়। হত্যাচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত বদরুল আলমের বিচারে খাদিজা বেগমের কথাও শুনতে চান আদালত। সিলেট মহানগর মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মো. সাইফুজ্জামান ১৫ ডিসেম্বর সর্বশেষ পর্যায়ের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আগামী ৮ জানুয়ারি আদালতে হাজির হয়ে খাদিজাকে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
একই বছরের ২৪ আগস্ট উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের পদচারী-সেতু পার হওয়ার সময় এক বখাটে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় সুরাইয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ আগস্ট রিসা মারা যায়। এ ঘটনায় ২৫ আগস্ট রিসার মা তানিয়া হোসেন বাদী হয়ে রমনা থানায় ওবায়দুলকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। পুলিশের কাছে ধরা পড়েন ওবায়দুল।
এই ঘটনাগুলো ছাড়াও গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে (প্রথম চার মাসের হিসাব) শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। নাটোরে এক মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের পর ধর্ষক যুবকের চাচা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যের বাড়িতে ৩০ হাজার টাকায় আপস করেন। ওই মীমাংসা বৈঠকে ধর্ষককে চড়-থাপ্পড় মেরে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। চলতি বছরে খুলনায় উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তা পারভীন সুলতানা (২৬) ও তাঁর বাবা ইলিয়াস চৌধুরীকে (৬০) হত্যা করেন লিটনসহ চারজন (লিটন আদালতে জবানবন্দি দেন)। হত্যার আগে পারভীনকে ধর্ষণ করেন তাঁরা। এরপর তাঁদের লাশ গুম করতে সেপটিক ট্যাংকে ঢুকিয়ে রাখা হয়। ১৯ অক্টোবর বখাটেদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় মিরপুরে একাদশ শ্রেণির যমজ বোনকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে বখাটেরা। বখাটের হামলায় প্রাণ যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী কণিকা ঘোষের ও মাদারীপুরের নিতুর। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে এ বছর।
কিছু ভালো আইন থাকা সত্ত্বেও কেন এমন হচ্ছে? এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘শুধু আইন থাকলেই হবে না, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন প্রয়োজন। তনু হত্যা মামলার কোনো অগ্রগতি হলো না। তনুর বাবা যখন আমাকে ফোন করেন, আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারি না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে তনু নামে কেউ মরে যায়নি। সিলেট কোর্ট কিন্তু নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রাজন ও খাদিজা মামলার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার ছাড়াও অগ্রগতি খুবই ভালো। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করব, আগামী বছর মেয়েদের সব ক্ষেত্রে হয়রানি, নির্যাতন যেন কমে যায়। এর জন্য প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। সচেতন হতে হবে। তা না হলে প্রকৃত অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না।’
এসএ গেমসে মাবিয়ার সোনা জয়
মাবিয়া আক্তার। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের (এসএ গেমস) ভারোত্তোলনে সোনা জয় করেন। দেশের পক্ষে প্রথম সোনা জয়ের পর ভারতের গুয়াহাটিতে বিজয় মঞ্চে জাতীয় সংগীত বাজার সময় আবেগে কাঁদেন তিনি। তাঁর কান্না দেখে দেশবাসীও কাঁদেন। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া কমনওয়েলথ জুনিয়র ও যুব ভারোত্তোলনেও সোনা জেতেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়ি চালালেন মিতা বিশ্বাস
এ বছর প্রথমবারের মতো পুলিশ সপ্তাহের প্যারেড পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী খোলা গাড়িটি চালিয়েছেন নারী পুলিশ সদস্য মিতা বিশ্বাস। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালানোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ধন্যবাদও দেন। পুলিশ সপ্তাহের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নারী সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি চালানোর দায়িত্ব পান মিতা বিশ্বাস। পুলিশ সপ্তাহ শুরু হওয়ার ১০-১২ দিন আগে প্যারেড পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়ি চালাতে হবে বলে মিতা বিশ্বাসকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
বিজিবির প্রথম নারী সদস্য
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সৈনিক পদে এবারই প্রথম নারী সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজিবির ৮৮তম ব্যাচে ৯৭ জন নারী গত ৫ জুন সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নেন। বর্তমানে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন।
আবার অ্যাসিড-সন্ত্রাস
২০১৬ সালের শুরু থেকেই পত্রিকায় পাতাজুড়ে ছিল অ্যাসিড-সন্ত্রাসের খবর। ২০১৪ ও ১৫—এই দুই বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল ৭৪টি। চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ নয় মাসে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা ৩৬। এর মধ্যে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, অন্তত সাতটি করে। এসব ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪২ জন। এর মধ্যে একজন নারী মারা গেছেন।
২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের শেলী আক্তার (২২) নিজ ঘরে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনার এক দিন পরই রাজধানীতে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হন ২২ বছরের গৃহবধূ নাসিমা আক্তার। তিনি স্বামীর সঙ্গে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি নাসিমাকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করেন।
প্রথম আলো ট্রাস্ট ও অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নাসিমা আক্তারের ওপর অ্যাসিড-সন্ত্রাসের প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়। বিভিন্ন সংগঠন সারা দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাস প্রতিরোধে মানববন্ধন করে।
আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেলেন মেরিনা তাবাসসুম
ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদের স্থাপত্য নকশার জন্য স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম এ বছর আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পান। স্থাপত্যের দুনিয়ায় অত্যন্ত সম্মানজনক এ পুরস্কার। তাঁর আগে বাংলাদেশের কোনো নারী এই পুরস্কার অর্জন করেননি। তাঁর পাশাপাশি গাইবান্ধায় ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্যের জন্য স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীও এ পুরস্কার পান এ বছর।
হারিয়েছি নূরজাহান বেগমকে
বেগমপত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম চলে গেলেন ২৩ মে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বেগম বাংলার প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক। সাহিত্যক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসে বেগম। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। পরে পত্রিকাটির সম্পাদনা শুরু করেন নূরজাহান বেগম। তাঁর বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন বেগম পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা।
চলে গেলেন জয়াপতি
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জয়াপতি (৮৪) ৯ ডিসেম্বর লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান। ১৯৩২ সালে তিনি মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
গ্রন্থনা: তৌহিদা শিরোপা