১৮ হাজার মিনিটের ৭০ মিনিট

>

শুটিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
শুটিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

টানা পাঁচ বছর কাজ করেছেন। ভিডিও চিত্র ধারণ করেছেন প্রায় ৩০০ ঘণ্টা। সেখান থেকেই তৈরি করেছেন ৭০ মিনিটের ডকুড্রামা—হাসিনা: আ ডটার’স টেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নির্মিত সদ্য মুক্তি পাওয়া তথ্যচিত্রটির নির্মাতা পিপলু আর খান। তিনি শুনিয়েছেন অভিজ্ঞতার কথা।

ক্যামেরা, লাইট প্রস্তুত।

ক্যামেরার পেছন থেকে বললাম, ‘আপা, আসেন।’

নিচতলার করিডর পেরিয়ে তিনি শুধু একটু হেঁটে আসবেন, এটুকু আগেই বলা। অপর প্রান্তে ক্যামেরা চলছে। কিন্তু তিনি আসছেন না। ক্যামেরার পেছন থেকে তাই আবারও ডাকলাম, ‘আপা, আসেন।’ তবুও যখন তিনি আসছিলেন না, ক্যামেরা অন রেখেই সামনে গেলাম। দেখি দরজার ওপাশটাই তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে। নির্বাক। দ্রুত কাছে গেলাম। আপা সস্নেহে আমার হাতটা ধরলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একদৃষ্টিতে বললেন, ‘এখানেই, এই জায়গাতেই আমার ভাই (শেখ রাসেল) প্রথম হাঁটা শুরু করে।’

তাঁর কথা শুনে স্তম্ভিত হলাম। কী বলব। ওই মুহূর্তটা পুরো শুটিংয়ের মেজাজটাই বদলে দিল। ৩২ নম্বরের বাড়িতে শুটিংয়ের এই মুহূর্তটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। মনে থাকবে কারণ, হাসিনা: আ ডটার’স টেল তথ্যচিত্রের জন্য সেটাই ছিল আয়োজন করে, প্রধানমন্ত্রীর সময় নিয়ে কোনো দৃশ্যধারণের ঘটনা।

আরও কিছুটা সময় পরে সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটা আমাদের ঘুরে দেখিয়েছিলেন তিনি। যেখানেই যাচ্ছিলেন একেকটি ইতিহাস উন্মোচিত হচ্ছিল তাঁর কথায়। যদিও আমরা তাঁর কাছে কোনো প্রশ্ন করতে চাইনি। জানতাম, এখানে এলে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে যাবেন। তাঁকে কষ্ট দিতে চাইনি বলেই অতীতের কোনো কথা জানতে চাইনি।

সেদিন পুরো বাড়ি ঘুরে একসময় ছাদে গিয়েছিলেন। কিছু কবুতর বসে ছিল গাছে। আপা ডাকলেন, ‘তোমাদের কেউ এই ছবিটা নিতে পারে?’ আমরা ভেবেছিলাম তিনি ভিডিও করতে বলছেন। তখন বলেন, ‘গাছের ওপর কবুতর বসা। এই ছবিটা আমি চাচ্ছি।’ গিয়ে দেখি অসাধারণ এক দৃশ্য। অনেক কবুতর বসে আছে। এই কথোপকথনের ভিডিও তো এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল।

এমন হাজারো স্মৃতি জমেছে তথ্যচিত্রের কাজটি করতে গিয়ে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর রান্নার ছবিটা। সে ছবিও তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। এটা আমাদের কাজের একটি ছবি। তবে আয়োজন করে নয়। সেদিন তিনি রান্নাই করছিলেন। শুক্রবার ছিল। আমরা হাজির হয়েছিলাম।

এমন যেদিন রান্না করতেন, সেদিন বলতেন খেয়ে যেতে। প্রধানমন্ত্রীর রান্নার স্বাদের কথা, নাই–বা বললাম!

হাসিনা: অা ডটার’স টেল তথ্যচিত্রের পোস্টার

আরও আছে টুঙ্গিপাড়া

প্রধানমন্ত্রীর সিঁড়ি ভেঙে ওঠার যে দৃশ্যটা ট্রেলার এবং মূল তথ্যচিত্রে দেখা যায়, অনেকে মনে করেন এটা ৩২ নম্বরে ধারণ করা। অবশ্য দেখতেও কিছুটা মিল রয়েছে। এই সিঁড়িটি টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির। এই দৃশ্য ধারণ করার কাজটি বেশ কঠিন ছিল। কারণ প্রধানমন্ত্রী দ্রুত পথ চলেন। টুঙ্গিপাড়া গেলে তো তিনি আরও প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ হয়ে ওঠেন। সেদিন সিঁড়ির দৃশ্যটা ধরতে ক্যামেরা আগেই তৈরি ছিল। তবে আমরা যতটুকু সময় পাব ভেবেছিলাম, তার অর্ধেকটা পেলাম। সেদিন তিনি সিঁড়ির দুই ধাপ একবারে মাড়ালেন! তখন ফের তো বলতে পারি না, আবার একটু আসেন!

কাজের খাতিরে কতবার যে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছি, তার হিসাব নেই। পান্না লালের গাওয়া ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরাল’ গানের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ার যে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় তা এক দিনের নয়। সেখানে দুই বছর ধরে, বিভিন্ন মৌসুমের দৃশ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়, সে প্রচেষ্টায় সফল হয়েছি।

এখানে প্রধানন্ত্রীর চা–মুড়ি খাওয়ার গল্পটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি প্রায়ই চা–মুড়ি খান। আমি ভাবলাম এই দৃশ্যটা নেওয়া দরকার। টুঙ্গিপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর একটা কক্ষ আছে। মেঝের এক কোনায় গদি আঁটা। সেখানেই বসেন তিনি। একবার টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললাম, ‘আপা, চা–মুড়ি খাবেন!’ তিনি ব্যাপারটা বুঝে ফেলে বললেন, ‘শেষমেশ তোমরা আমার চা–মুড়ি খাওয়ার দৃশ্যও নিয়ে নেবে!’ যদিও সে ভিডিও আমরা তথ্যচিত্রে ব্যবহার করিনি।

এত কিছু করার একটিই কারণ। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় দেখি, তার বাইরের একজন মানুষকে দেখার চেষ্টা। স্বাধীনতার জন্য যে পরিবারটার এত ত্যাগ, সেই পরিবারের গল্পটা সংরক্ষণ করার প্রয়াস। আমি কিছুটা করে রাখছি। কে কীভাবে নেবে, এটা একান্তই তাঁর ব্যাপার। তবে অনেকেই যে উপকৃত হবেন, এটুকু তো বলতেই পারি। এই ছবিতে শুধু একটি পরিবারকে ধরা হয়নি। সেখানে উঠে এসেছে একটি সময়। বাংলাদেশের ইতিহাস। যদিও কাজের শুরুটা করেছিলাম নিছকই ডকুমেন্টেশনের উদ্দেশ্যে।

গিয়েছিলাম গণভবনে

প্রথম উদ্দেশ্যই ছিল প্রধানমন্ত্রীর কিছু সাক্ষাৎকার নেব। সম্পাদনা করে সেগুলো প্রযোজকদের হাতে তুলে দেব।

সেই সূত্র ধরেই ২০১৩ সালের কোনো একদিন গণভবনে অপেক্ষা করছিলাম। প্রধানমন্ত্রী তখনো ভেতরের কক্ষে। একটু পর এলেন। কোলে ছোট্ট এক শিশু। শুক্রবার, ছুটির দিন বলেই নির্ভার দেখাচ্ছিল তাঁকে। ছুটির দিনটা নিজের মতো করে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান তিনি। সেদিন আগে থেকেই জানতেন আমরা আসব। কাছে এসে বললেন, ‘কী করতে হবে?’

কথা শুনে মনে হলো, তিনি খুব একটা সময় দিতে চাইছেন না। ইতস্তত করে বললাম, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিজের মতো সময় কাটান, আমরা আমাদের মতো দৃশ্য ধারণ করছি।’

শুরু হলো দৃশ্যধারণের কাজ। সত্যি বলতে কি, আমরা তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত ধরতে চেয়েছিলাম। ক্যামেরায় বন্দী করতে চেয়েছিলাম রাজনীতির মাঠের বাইরের একজন সাধারণ মানুষকে; যিনি কারও মা, কারও বোন, কারও হয়তোবা নানি।

তাই সেদিন বলেছিলাম, ‘মাঝেমধ্যে আসব, আপনার কিছু বিষয়, কিছু কথা রেকর্ড করব।’ এ–ও বললাম, ‘আমি কিন্তু আপনাকে আপা বলে ডাকব!’

এই অনুমতি প্রার্থনার কারণ যতটা না তাঁকে সহজ করে নেওয়া, তার চেয়ে বরং নিজেকে তাঁর কাছে সহজ করার চেষ্টা। যাতে মনের কথাটুকু সহজে বলতে পারি।

হাসিনা: আ ডটার’স টেল নামে যে তথ্যচিত্রটি মুক্তি পেল, পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের সেই সময়টাতে তার ছিটেফোঁটাও মাথায় ছিল না। আগেই বলেছি, তাঁর পরিবারের সদস্যদের উদ্যোগে আমরা শুধু কিছু জীবনের গল্প ক্যামেরাবন্দী করছিলাম।

তবে প্রথম দিনটাই আমাকে নতুন এক জানালা খুলে দিয়েছিল। সে জানালাটি ছিল—জানার। কথায় কথায় সেদিন প্রধানমন্ত্রীর মুখে শুনেছিলাম, টুঙ্গিপাড়া ছেড়ে তাঁদের ঢাকা আসার গল্প। তিনি বলছিলেন ঠিক গল্পের মতো করে। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে নদী পার হয়ে ঢাকায় আসছেন। ধানমন্ডির বাসায় উঠছেন। বাড়ির আশপাশে তখন ধানখেত, পাশেই থাকেন সুফিয়া কামাল। কবির সঙ্গে সখ্য...।

এই অন্য রকম এক ঢাকার গল্প শুনে সেই সময়টা সম্পর্কে জানার আগ্রহ তীব্র হতে থাকল। আমি পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। বঙ্গবন্ধুর বই পড়লাম। হিসাবও করতে পারব না, পাঁচ বছরে জাতির জনককে নিয়ে, তাঁর পরিবার নিয়ে, সে সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কত বই পড়েছি।

২০১৩ সালজুড়ে ১০ দিনের মতো প্রধানমন্ত্রীর সময় পেয়েছিলাম। এই ৮-১০ দিনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ থেকে ১০ মিনিটের তথ্যচিত্র বানালাম। সেটা আহামরি কিছু ছিল না। নেপথ্য সংগীত দিয়ে কিছু কথাবার্তা। কিন্তু ওই ভিডিও দেখে মনে হলো আমরা তো নতুন কিছু করতে পারব। এরপর যা–ই ভিডিও করলাম তা মানসম্পন্ন করে করলাম। নিজের মধ্যেই একটা কাঠামো গড়ে তুললাম।

২০১৪ সালের শেষে দিকে আমি মনে করলাম, এটা নিয়েই ছবি করব। আমার প্রযোজকেরাও রাজি। কাজ শুরু করি তথ্যচিত্রের। তখন কাজের পরিসর বাড়ল। বাড়ল সীমাবদ্ধতাও। আমাদের ইতিহাসবিমুখতার, ইতিহাস সংরক্ষণ না করার প্রবণতা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। একটা তথ্য পেতে, কোনো একটা ছবি পেতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে।

তবে সবকিছু সামলে দিনে দিনে যা সংগ্রহ করলাম, তাতে তো ১০টা সিনেমা তৈরির উপাদান জমে গেল। সময়ের হিসাবে প্রায় ৩০০ ঘণ্টার ফুটেজ। অনেকেই বলেন, ৭০ মিনিটের তথ্যচিত্রটা তো আরও বড় করা যেত। আমিও জানি, যেত। কিন্তু এটার পরিপূর্ণতা দিতে এতটুকুই দরকার ছিল। তাই এখন হয়তো মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। বাকি ফুটেজ থেকে কখনো কিছু করব কি না, চিন্তা করে দেখিনি। তবে এগুলো মানুষের কাজে লাগলেই আমার পাঁচ বছরের লেগে থাকা সার্থক হবে।