এইচএসসি পাস করার পরপরই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়াশোনা করা হয়নি। ১৮ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই লেখাপড়াই আবার নতুন করে শুরু করেছেন জাকিয়া সুলতানা, ভর্তি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংসার ও দুই মেয়ে সামলানোর পাশাপাশি নিজেই গড়ে তুলেছেন একটি বুটিক কারখানা, যেখানে কাজ করেন ৪৫ জন। তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প থাকছে এখানে
১৮ বছর আগে আলম খানের সঙ্গে যখন বিয়ে হয়, সদ্যই তখন এইচএসসি পাস করেছেন জাকিয়া সুলতানা। বিয়ের পর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একে একে তাঁর কোলজুড়ে আসে দুই সন্তান। একসময় জীবনটাকে শুধু ঘরকন্নায় আটকে রাখতে মন চাইল না। ২০১৮ সালে মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় ‘হ্যাভেন ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন’ নামে নিজের একটা প্রতিষ্ঠান দিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ভালো করে দাঁড় করার আগেই হানা দেয় করোনা। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন জাকিয়া সুলতানা। শত বাধার মধ্যেও নিজের প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে গেছেন। অনলাইন ও পরিচিতদের কাছে পোশাক বিক্রি করে করে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখেন।
একসময় বাড়তে থাকে কাজের পরিধি, সেই সঙ্গে বাড়ে কর্মীর সংখ্যা। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৪৫ জন কর্মী। রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানের আশকোনায় তাঁর বুটিক হাউসের কারখানা। সেখানে তৈরি হয় পোশাক, গয়না, জুতাসহ নানা পণ্য।
কিন্তু একটা ক্ষোভ তাঁর রয়েই গিয়েছিল, পড়াশোনা শেষ করা হয়নি। ছোট ভাইও তাঁকে উৎসাহ দিতে থাকেন। মূলত তাঁর উৎসাহেই নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। প্রথমে প্রবাসী স্বামীর অনুমতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুমতিও মেলে। ২০২১ সালে রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনে ভর্তি হন জাকিয়া সুলতানা। ছোট্ট দুই মেয়ের একজন ফাইভে, অন্যজন প্লেতে পড়ে। নিজ প্রতিষ্ঠান চালিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা তাঁর জন্য রীতিমতো লড়াইয়ের শামিল। সকাল আটটা থেকে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন, চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। এর মধ্যেই বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়া ও পড়াশোনারও খেয়াল রাখেন।
বর্তমানে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়াশোনা করছেন জাকিয়া সুলতানা। ‘অসম বয়সীদের সঙ্গে পড়াশোনা করতে দারুণ লাগে। সবাই আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়েছেন। তাঁরা এখন পরিবারের সদস্যদের মতো’—হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেন জাকিয়া সুলতানা। তাঁর বিভাগের শিক্ষকেরাও তাঁকে উৎসাহ দেন নিয়মিত। এমনই একজন রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘উপাচার্য স্যার সব সময় আমাদের সহযোগিতা করেন। যেকোনো প্রয়োজনেই আমাকে স্যার পরামর্শ দেন। শুধু পড়াশোনা বিষয়েই নয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও স্যার নিয়মিত খোঁজখবর নেন।’
৪৫ জন কর্মীর মধ্যে চারজন পুরুষ, বাকি সবাই নারী। বেশির ভাগই তাঁর ভার্সিটির বন্ধু বা সহপাঠী। ঢাকার বাইরে থেকে এসে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে উপার্জন করতে চান, তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জাকিয়া সুলতানা। নানাভাবে তাঁদের নিজের প্রতিষ্ঠান কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি।
‘পড়াশোনা করে যারা কাজ করতে চায়, তাদের কষ্টটা আমি বুঝি। পড়াশোনার পাশাপাশি তারা যদি কাজের সুযোগ পায়, তাহলে পরিবারের ওপর কিছুটা চাপ কমে। সেই চিন্তা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের আমি কাজের সুযোগ করে দিই’—জানান জাকিয়া সুলতানা। তাঁর প্রতিষ্ঠানে অনেক মেয়ে আছেন বিবাহিত এবং সন্তানের মা। বাচ্চাদের কাছে রেখেও কাজের ব্যবস্থা রেখেছেন জাকিয়া সুলতানা। নিজের মেয়েদের মায়ের কাছে রেখে কাজে যান জাকিয়া। তাই মায়েদের জন্য সন্তান কাছে রাখার বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সহকর্মীরা নিশ্চিন্তে যাতে কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
সামনে জামদানি নিয়ে কাজ করতে চান জাকিয়া। দেশীয় পোশাক ও প্রকৃতির উপকরণ ব্যবহার করে নকশায় আনতে চান নতুনত্ব। ফ্যাশন ডিজাইনে পিএইচডি করার ইচ্ছা তাঁর। সারা দেশের মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান জাকিয়া সুলতানা। দেশে–বিদেশে তাঁর করা নকশার পোশাক পরে মডেলরা র্যাম্পে হাঁটবেন, এমনটাই স্বপ্ন দেখেন তিনি।