হোঁচট খেয়ে উঠে দাঁড়ানো একজন শফিকুল

বাবা নেই। মায়ের তখন একমাত্র আশা ৭ বছরের শফিকুল। পোশাকশ্রমিক মা ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। একদিন ছুটির পর খেলার ছলে শফিকুল উঠেছিল ট্রেনে। বাড়ির কাছেই রেলওয়ে স্টেশন। কতই না খেলেছে পড়ে থাকা ভাঙাচোরা বগিতে। কিন্তু এবারের বগি যে চলন্ত ট্রেনের, সেটা বুঝেছিল চলতে শুরু করার পর। এভাবে চলে আসে পাহাড়তলী থেকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে। নেমেই কৌতূহলী চোখে তাকায় চারপাশ। সবকিছুই অচেনা। জেঁকে বসে ভয়। কীভাবে ফিরবে বাড়ি?

শত চেষ্টার পরও ছোট্ট শিশু আর বাড়ির পথ খুঁজে পায়নি। ট্রেনে চড়েই চলে যায় ঢাকার কমলাপুর। শফিকুলের ঠাঁই হয় পথে পথে, পরিচয়—পথশিশু। বোতল-কাগজ কুড়ানো, আইসক্রিম বিক্রি, পত্রিকার হকারি, হোটেল শ্রমিক, গৃহকর্মী—বাঁচার তাগিদে সব কাজই করতে হয়েছে। পদে পদে জুটেছে অবজ্ঞা, অপমান, অবহেলা।

সেই শিশুর পুরো নাম শফিকুল ইসলাম খান। শিশু-কিশোরদের অধিকারবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সংগঠন নির্যাতিত শিশু-কিশোরদের পাশে দাঁড়ায়। সচেতন করে অধিকার সম্পর্কে।

১৮ নভেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের বাকলিয়ার ডিসি রোডের কালাম কলোনিতে ভোরের আলোর একটি শাখা কার্যালয়ে কথা হয় শফিকুলের সঙ্গে। ঘুপচি গলি পেরিয়ে বস্তিতে ছোট্ট এক কামরার কার্যালয়টি। ভেতরে মাদুর পাতা। সংগঠনের শিশু-কিশোর দলের সদস্যরা আছে। একটু পর সদস্যরা মীনা, রাজু ও মিঠু সেজে বেরিয়ে পড়বে ঘরে ঘরে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে, চলছিল সেই প্রস্তুতি। এর ফাঁকে কথা হয় শফিকুলের সঙ্গে। এখন তিনি পেশায় সাংবাদিক। সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকায়।

‘হোঁচট খেয়েছি, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।’ নিজের জীবন নিয়ে বলেন শফিকুল। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাস। প্রচণ্ড খিদে নিয়ে শুরু হয়েছিল শফিকুলের ঢাকার জীবন। মিশে যান স্টেশনের শিশুদের ভিড়ে। শফিকুল বলেন, ‘পেট চালাতে প্রথমে শুরু কুলিগিরি। ৩০-৪০ টাকা আয় হতো দিনে। তা দিয়ে খাবারদাবার খেয়ে স্টেশনেই ঘুমাতাম।’

দুর্ঘটনায় ঘুরে দাঁড়ানো

শফিকুল একদিন ট্রেনে চড়ে বন্ধু সোহেলের সঙ্গে যাচ্ছিলেন তেজগাঁও। সেখানকার কলার আড়ত থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কলা এনে বিক্রি করবেন। যাওয়ার পথেই চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে দুজনই গুরুতর আহত হন। শফিকুলের পা কেটে যায়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অপরাজেয় বাংলাদেশের কর্মীরা তাঁকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান। হাত বাড়িয়ে দেন সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী ওয়াহিদা বানু। চিকিৎসাকেন্দ্রে আসা বিদেশি চিকিৎসকের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করান। সেই যাত্রায় রক্ষা পায় পা।

শফিকুল ইসলাম খান। ছবি: সৌরভ দাশ

এরপর অন্যভাবে জীবনকে দেখা শুরু। পরিবার হয়ে উঠল অপরাজেয় বাংলাদেশ। ভোরে কাগজ-বোতল কুড়ানো কিংবা পত্রিকা বিক্রি। দিনে পড়া। এভাবে ঢাকার খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, খিলগাঁও মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন শফিকুল।

ফুটল ভোরের আলো

অপরাজেয় বাংলাদেশের হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়ার সময়ই শফিকুল নানাভাবে শিশু অধিকার কার্যক্রমে যুক্ত হন। বিভিন্ন সময় ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেনস ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। সভা-বৈঠকে কথা বলেন অনর্গল। জানাশোনার পরিধিও বেড়েছে। ২০০১ সালের দিকে তাঁর মতো পথে বেড়ে ওঠা আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ‘ভোরের আলো’। এরপর একুশে টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে। সেই প্রতিবেদন চোখে পড়ে মা রাবেয়া খাতুনের।

শফিকও পাহাড়তলী গিয়ে মায়ের খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু খুঁজে পাননি। একদিন অপরাজেয় বাংলাদেশের মিরপুর হোস্টেলে এসে হাজির মা। সময়টা ২০০২ সালের ডিসেম্বর। মাকে পাওয়ায় ঢাকায় মন টেকানো দায় হয়ে পড়ে। ২০০৪ সালে চলে যান চট্টগ্রামে। স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন সিটি কলেজে। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে আবার যাত্রা শুরু করে শফিকুলের সংগঠন ভোরের আলো।

ঘরের দুয়ারে মীনা, রাজু ও মিঠু

১৮ নভেম্বর দুপুর। বাকলিয়ার কালাম কলোনির এক বস্তিপাড়ায় ছোট ছেলেমেয়েদের জটলা। মীনা, রাজু ও মিঠু দুয়ারে হাজির! কেউ মীনার সঙ্গে হাত মেলায়, কেউ দুষ্টুমিতে মাতে মিঠুর সঙ্গে। এর ফাঁকে বড়রাও এসে হাজির। মীনা শিশুদের কাছে জানতে চায়, ‘তোমরা খাওয়ার আগে ভালোভাবে হাত ধোও?’, ‘তোমরা নিয়মিত হাতের নখ কাটো?’ সবাই সমস্বরে উত্তর দেয়, হ্যাঁ।

কালাম কলোনির বাসিন্দা গৃহিণী আমেনা বেগম বলেন, ‘এরা প্রায় সময় আইস্যা ভালো ভালো কথা বলে। তাদের কথার পর আমার ছোড পোলাডারে স্কুলে দিছি।’ মীনা মাপেট পরে ঘুরে বেড়ান ভোরের আলোর কিশোরী দলের সদস্য উম্মে সালমা। এবার এইচএসসি পাস করেছেন। সালমা বলে, ‘আমি এই কালাম কলোনিতে বড় হয়েছি। এখানকার মানুষ অসচেতন। ভোরের আলো এসে তাদের সচেতন করে। ’

কার্টুনের পোশাক পরে ঘরে ঘরে গেলে তাঁরা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। এভাবে ভোরের আলোর শিশু-কিশোর দল ভাগ হয়ে কাজ করে। বলেন শফিকুল ইসলাম খান। ভোরের আলোর কার্যক্রম চলছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাকলিয়ার তিনটি ওয়ার্ডে। বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে। বিশেষ করে কিশোরীদের বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করা হয়। মাসিকের সময় যেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। এ জন্য বিনা মূল্যে সেসবও দেওয়া হয়।

ভাগ্যহতদের পাশে

ঘটনাটি ২০০৯ সালের। চট্টগ্রাম নগরের একটি পাড়ায় বখাটের উৎপাত ছিল। গরুর দুধ বিক্রি করতে আসা-যাওয়ার পথে ১১ বছরের মেয়েশিশুটিকে উত্ত্যক্ত করত বখাটেরা। হঠাৎ একদিন নিখোঁজ সে। ২১ দিন ধরে চারজন মিলে নির্যাতন চালায় তার ওপর। পরে ফেলে যায় বাসার কাছেই। স্বেচ্ছাসেবকেরা খবর দেন শফিকুলকে। তিনি এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড়ান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চার মাস চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়। এখনো ধর্ষণের মামলা চলছে। সেই শিশু এখন ২১ বছরের তরুণী। তাঁকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা হয়েছে।

শিশুদের মীনা মাপেট দেখিয়ে সচেতন করেন শফিকুল

এ পর্যন্ত ভোরের আলোর উদ্যোগে নার্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ২৬ জনকে। ৮৪ জনকে নিজস্ব কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার থেকে তথ্যপ্রযুক্তি এবং দুই শতাধিক মেয়েকে সেলাই ও হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শারমিন আক্তার কাজ করছেন চট্টগ্রামের একটি ফ্যাশন হাউসে। তাঁর মাসিক আয় এখন ১৪ হাজার টাকা।

স্বপ্ন যত

ভোরের আলোর কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে তিন পার্বত্য জেলাতেও। এরই মধ্যে পার্বত্য এলাকায় ৬০টি বিদ্যালয়ে কিশোরীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা হয়েছে।

বড় আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা। যেখানে পিছিয়ে পড়া শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা বিনা মূল্যে পূর্ণাঙ্গ তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাবে। শফিকুল বলেন, ‘আমাদের কোনো কার্যালয় ছিল না। মাঠেই কাজ করেছি। চলতি মাসেই কর্নেলহাটে একটি দুই কক্ষের কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। আর্থিকভাবে কারও সাহায্য না নিয়ে চলছি। নিজের বেতনের কিছু টাকা ও সদস্যদের সামান্য চাঁদায় চলে এই সংগঠন।’

শফিকুল স্বপ্ন দেখেন, সুবিধাবঞ্চিত কথাটি যেন আর না থাকে। সবাই খেয়েপরে সচ্ছল জীবনযাপন করুক—এটাই চাওয়া।