ভালোবাসার গল্প আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। বিপুল সাড়া দিয়েছেন পাঠকেরা। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। বাছাই একটি গল্প রইল এখানে।
২৮ বছর বয়সে যেভাবে কমিকস গিলি, সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আমার বন্ধুরা তো বটেই, মা-বাবাও কথাটা বলেন। কিন্তু আমি নিরুপায়। এই বয়সে এসে নিজের স্বভাব পাল্টানো কঠিন। আমি অবশ্য কমিকসের নেশা ছাড়তেও চাই না। সেটা শুধু কমিকস ভালোবাসি তার জন্য নয়, বরং এর পেছনে আছে অন্য এক গল্প।
আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। খরচ কুলিয়ে উঠতে পারতেন না বলে শহরে একাই থাকতেন। আমরা থাকতাম গ্রামে। আমি গ্রামের স্কুলে পড়তাম। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার পর বাবার কাছে জেদ ধরলাম শহরে যাব। এটা-সেটা বলে আমাকে ঠেকানোর চেষ্টা করলেন বাবা। শুনলাম না। মা-ও বললেন নিয়ে যেতে।
পুরান ঢাকার আগামসিহ লেনের মেসে পৌঁছে বুঝলাম, কেন আনতে চাইছিলেন না। পুরোনো আমলের প্রায় পরিত্যক্ত একটা ভবনে বাবারা মেস করে থাকেন। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, দিনের বেলাও চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হয়। ঢাকা দেখার শখ আমার তত দিনে মিটে গেছে। সারা দিন একা একা রুমে থাকি আর গ্রামের কথা ভেবে মন খারাপ করি। একদিন সন্ধ্যায় বাবা এসে বললেন, ‘চল তোকে একটা দাওয়াতে নিয়ে যাই।’
বাবার বসের বাসায় দাওয়াত। গিয়ে চমকে উঠলাম। প্রকাণ্ড ফ্ল্যাট। দামি দামি আসবাব। শোকেসে এমন সব শোপিস, যা আগে কোনো দিন দেখিনি। সেটা ছিল বাবার বসের মেয়ের জন্মদিন। জনাকীর্ণ ড্রয়িংরুমের এক কোণে বসে বড় বড় চোখ করে কাণ্ডকীর্তি দেখছিলাম। এমন সময় গুড়িয়াকে দেখতে পেলাম। আজ তার জন্মদিন। সাদা রঙের একটা গাউন পরেছে। মাথায় ক্রাউন আর হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড। আমার বয়সী একটা মেয়ে যে এত সুন্দর হতে পারে, জানা ছিল না। হঠাৎ নিজের সাদামাটা পোশাক নিয়ে খুব অস্বস্তি হতে লাগল।
কী মনে করে গুড়িয়ার বাবা আমাকে কেক কাটার টেবিলে ডেকে নিলেন। কেক আর স্ন্যাকস খেয়ে বড়রা যখন রাজনীতি ও অফিস নিয়ে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আমি তখন উদাস মুখে একা বসে রইলাম। গুড়িয়া বোধ হয় আমাকে লক্ষ করে থাকবে। কোত্থেকে এসে সে বলল, ‘তুমি কি হি-ম্যানকে পছন্দ করো?’
‘কী ম্যান?’ মুখ ফসকে বলে ফেললাম। গুড়িয়া হি হি করে হেসে ফেলল। আমার টি-শার্টটা দেখিয়ে বলল, ‘না করলে ওর টি-শার্ট পরেছ কেন?’
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে রইলাম। দুই দিন আগে গুলিস্তান থেকে এই টি-শার্ট কিনে দিয়েছেন বাবা। তাতে কার ছবি আছে, খেয়াল করিনি।
গুড়িয়া বলল, ‘রুমে চলো। তোমাকে হি-ম্যানের কমিকস পড়তে দিচ্ছি।’
পেছন পেছন যাওয়ার সময় আমি একবার বাবার দিকে তাকালাম। চোখেমুখে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।
গুড়িয়ার রুমভর্তি টেডি বিয়ার আর কমিকস বই। বেশির ভাগ কমিকসই ইংরেজি। টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স, আর্চি, সুপারম্যান ও ব্যাটম্যানের কমিকস। হি-ম্যানের কমিকসগুলো সাইজে ছোট। হাতের তালুর সমান। তারই একটা আমার বুকের কাছে রেখে গুড়িয়া বলল, ‘এই দেখো হি-ম্যান। মাস্টারস অব দ্য ইউনিভার্স।’
আমি গুড়িয়ার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে ছিলাম। এই কয় দিনের বিষণ্নতা এক ফুৎকারে যেন উড়ে গেল। কাঁপা গলায় বললাম, ‘আমি এসব কখনো পড়িনি।’
একটু হেসে কিছু কমিকস বেছে আমাকে ধরিয়ে দিল গুড়িয়া। ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা। গুড়িয়া ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, নাম লিখে দিই। আমার কথা তাহলে মনে থাকবে।’
কমিকসগুলো হাতে নিয়ে বাবার প্রহরায় ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। খাওয়াদাওয়া সেরে যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, গুড়িয়া বলল, ‘হি-ম্যানের ওয়াইফের নাম জানো?’
‘শি-ম্যান?’ মুখ ফসকে বেমক্কা বেরিয়ে এল।
এক চোখ টিপে গুড়িয়া বলল, ‘খুঁজে বের করো।’
বাবার মেসে ফিরে খুঁজতে গিয়ে দেখি গুড়িয়া ওর ফোন নম্বর লিখে দিয়েছে।