সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। পঞ্চগড়ের দিনমজুর আয়নাল হক ও জামিরন বেগমের ৩৫ বছরের সংসার। গত ১৮ এপ্রিল পারিবারিক বিষয়ে ঝগড়া হয় এই দম্পতির। এ সময় রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাকের কথা বলেন আয়নাল হক। বিষয়টি স্থানীয় গ্রাম্য মাতবরদের কানে পৌঁছাতেই শুরু হয় বিপত্তি। মাতবররা জামিরনকে হিল্লা বিয়ে দিতে বলেন। এতে রাজি না হওয়ায় ওই দম্পতিকে তাঁরা একঘরে করে রাখেন। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ১১ আগস্ট পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মতিউর রহমান বিষয়টি আমলে নেন এবং স্বপ্রণোদিত হয়ে আয়নাল হক ও জামিরন বেগম দম্পতিকে একঘরে করে রাখার ঘটনা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন। হিল্লা বিয়ে আইনে বৈধ নয়, আর মুখে বললেই তালাক হয়ে যায় না।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তি তালাক বা ডিভোর্স চাইতে হলে তাঁকে অবশ্যই আগে যথাযথ আইন মেনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হবে। রাগের মাথায় মুখে মুখে তালাক উচ্চারণ করলেই তালাক হয়ে যায় না। তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে তালাক দিতে চাইলে তাঁকে যেকোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর অপর পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাক গ্রহীতাকে ওই নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।
চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলে তবেই তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। যে পক্ষই তালাক প্রদান করুক না কেন, তালাক কার্যকরের পর তালাকটি যে কাজির মাধ্যমে নোটিশ সম্পন্ন করা হয়েছে, সে কাজি অফিসে নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করা আইনত বাধ্যতামূলক।
মূলত হিল্লা বিয়ে বলতে বোঝায় কোনো স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর আবার যদি ওই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে চান, তবে কুসংস্কার মতে, তালাকে দেওয়া স্ত্রীকে আগে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। পরে আগের স্বামী যদি রাজি থাকেন, তবেই পুনরায় ওই স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারবেন।
রাগের মাথায় গ্রামাঞ্চলে অনেকে তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে থাকেন। আসলে তাঁরা বিচ্ছেদ চান না। কিন্তু মৌখিক তিন তালাকেই এমন দম্পতির ‘বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে’—এই যুক্তি দেখিয়ে যদি কেউ সেই স্ত্রীকে হিল্লা বিয়ে করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন বা মুরব্বি ও সমাজপতিরা যদি কোনো ফতোয়া জারি করেন, তবে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। হিল্লা বিয়ে আইনে বৈধ নয়, এটি কুসংস্কার মাত্র।
এ সম্পর্কে মুসলিম আইনে যথাযথ বিধান থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। ২০০১ সালে হাইকোর্ট একটি রায়ে ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেন। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ ধারা লঙ্ঘন করে এবং এই ধারাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-তে হিল্লা বিয়েকে শুধু বেআইনি বলা হয়নি, বাংলাদেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের আইন অনুযায়ী হিল্লা বিয়ে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
আইন অনুযায়ী তালাক না দিলে বিয়েটি বৈধ থাকবে। সুতরাং প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি অন্য কাউকে বিয়ে করেন, সে ক্ষেত্রে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। সে ক্ষেত্রে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সেই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে। ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি জানেন যে নারী বিবাহিত এবং তা জানা সত্ত্বেও বিবাহিত নারীকে অপরাধমূলক উদ্দেশ্যে প্রলুব্ধ করা বা অপহরণ বা আটক করেন, তাহলে তাঁর দুই বছর জেল ও জরিমানা হতে পারে।
কাজেই সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতারা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে যেসব মনগড়া ফতোয়া জারি করেন, তা গুরুতর অপরাধ এবং আইনত দণ্ডনীয়। সমাজজীবনে কুসংস্কার গভীরভাবে প্রোথিত। এ ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এখনই।
লেখক: বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও কলামিস্ট