বিশ্বের নামীদামি হোটেলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিলটন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট অন্যতম। শত বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানের সিঙ্গাপুর শাখার প্রধান শেফের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাজী শাহেদ হাসান। গত বছর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তিনি পেয়েছেন ‘কারি লাইফ ইন্টারন্যাশনাল অনার অ্যাওয়ার্ড-২০১৮’। এই রন্ধনশিল্পীকে নিয়েই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
বাংলাদেশে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। তথ্যপ্রযুক্তির একটি বিষয়ে কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন কাজী শাহেদ হাসান। সে সময় পড়াশোনার পাশাপাশি আয় করার চিন্তা থেকেই কাজ নিয়েছিলেন স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয়। শেফের সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়েই বুঝলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়টির চেয়ে রান্নাই তিনি ভালো পারেন। এই ভালো লাগাই তাঁকে নিয়ে গেল রান্নার বিশাল জগতে। তথ্যপ্রযুক্তির পড়াশোনা ছেড়ে হাতে নিলেন রান্নার বই। এ যেন রান্না করতে গিয়েই রাঁধুনি বনে যাওয়া!
শুরুটা মায়ের রান্নাঘর থেকে
চলতি মাসের শুরুর দিকে সিডনিতে বসেই কথা হয় কাজী শাহেদ হাসানের সঙ্গে। কীভাবে একটি নামীদামি হোটেলের প্রধান শেফ হলেন? শাহেদ বলেন, ‘অনেকেই জিজ্ঞেস করেন আমি কেমন শেফ। আমার উত্তর, একজন আধুনিক শেফ, যার যাত্রা মায়ের রান্নাঘর থেকে শুরু।’
কাজী শাহেদ হাসান বর্তমানে সিঙ্গাপুরের হিলটন হোটেলের নির্বাহী শেফের দায়িত্ব পালন করছেন। গোটা বিশ্বের নামীদামি হোটেল ব্র্যান্ড আছে যে কটা, তার মধ্যে অন্যতম হিলটন হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। পর্যটনকেন্দ্রিক ১০৯টি দেশে রয়েছে হোটেলটির শাখা।
এই কাজ করতে গিয়ে হাসানের সাফল্যের ঝুড়িতে জমেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতি আর অভিজ্ঞতা। রান্নার জন্য বহু সম্মাননা পেয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে অনেক গুণী মানুষের মুখে শুনেছেন, ‘তোমার হাতে জাদু আছে’। যুক্তরাজ্যভিত্তিক কারি লাইফ অ্যাওয়ার্ডের আয়োজক যুক্তরাজ্যের কারি লাইফ মিডিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কারি লাইফ ম্যাগাজিন এবং কারি লাইফ ইভেন্ট গত বছর তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে ‘কারি লাইফ ইন্টারন্যাশনাল অনার অ্যাওয়ার্ড-২০১৮’ পদক।
শেফ হওয়ার স্বপ্ন
২০০৩ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতক পড়া বাদ দিয়ে ভর্তি হন আতিথেয়তা ও রান্নাবিষয়ক ডিপ্লোমা কোর্সে। অভিজ্ঞতা নিতে চাকরি নেন মেলবোর্নের ক্রাউন ক্যাসিনো হোটেলে। ‘আমি প্রচুর কাজ করতে চাইতাম। আমাকে যে কাজই দিত খুব মনোযোগ দিয়ে দ্রুত শেষ করে ফেলতাম। আমার এই দক্ষতা ও রান্নার প্রতি আগ্রহকে আমলে নিয়েছিলেন আমার ব্যবস্থাপক ইমানুয়েল আগাপিতস। চাকরির মাত্র ছয় মাস পার হতেই হোটেলের প্রায় ২২ জন শেফ ও অন্য কর্মীদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পাই।’ বললেন কাজী শাহেদ হাসান। এর ছয় মাস পর সেই হোটেলের প্রধান শেফের দায়িত্বই পান তিনি।
স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার
প্রায় তিন বছর ক্রাউন মেলবোর্নে কাজ করতে করতে রন্ধনশিল্পের পাঠও গুছিয়ে ফেলেন শাহেদ হাসান। নিজের পেশার শিখরে ওঠার স্বপ্ন যেন প্রতিনিয়তই তাড়া করছিল তাঁকে। সে ভাবনাতেই নিজেকে মেলে ধরেন তিনি। ২০০৬ সালে মেলবোর্ন থেকে চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সিডনির বিখ্যাত ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের অংশ ওয়েস্টিন সিডনিতে উচ্চপদস্থ শেফের দায়িত্ব পান।
হাসান বলছিলেন, ‘এটাই আমার পেশাগত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার শুরু। ২০০৭ সালে যোগ দিই সিডনি আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রের একজন শেফ হিসেবে। একই সময়ে দুই হাজারের বেশি অতিথির খাবারের ব্যবস্থা ও অন্য কর্মীদের পরিচালনা করার দায়িত্ব থাকত আমার ওপর। সে সময়ই আমার নির্দেশনায় গড়া একদল শেফ “সিডনি শেফ চ্যালেঞ্জ–২০০৭”–এর স্বর্ণপদক জেতে।’
ছুটেছেন বিশ্বদরবারে
ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা কাজী শাহেদ হাসানকে নিয়ে গেছে কাতারের রাজধানী দোহায়। সে ইচ্ছাই তাঁকে দারুণ এক সুযোগ এনে দেয়। ২০০৮ সালে হাসান জগদ্বিখ্যাত শেফ জিম জর্জের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘জর্জের সঙ্গে কাজ করব ভেবেই তখন ভয় লাগত। দুনিয়ার নামকরা শেফ তিনি। তবে তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে।’ সে সময় ২৪০ জন শেফের একটি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। দুই বছর সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে আবার ফিরে আসেন সিডনিতে। সিডনির শেরাটন হোটেলে যোগ দেন। নির্বাহী শেফের কাজ শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৫৪ জন শেফ এবং ১৫ জন সহকারী।’
এশিয়ায় যাত্রা
পরবর্তী কয়েক বছর জীবনের ছন্দ মিলিয়ে ফেলেন কাজী হাসান। ২০১৪ সালে হিলটন হোটেলের পক্ষ থেকে নির্বাহী শেফের দায়িত্ব পালনের আমন্ত্রণ পান। সেটা মালয়েশিয়ার হিলটনে। সুযোগ গ্রহণ করেন তিনি। মালয়েশিয়ায় এসে রান্নায় নতুনত্ব আনারও চেষ্টা করেন তিনি। মাংসের রান্নার জন্য হিলটনের অতিথিদের বেশ প্রশংসা পান। মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক এক প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সালে তাঁর রেসিপি সেরা মাংসের খাবার হিসেবে নির্বাচিত হয়। ২০১৫ সালের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কার হিলটনের উঁচু পদে বদলি হন তিনি। সেখানে নতুন নতুন খাবার তৈরির পাশাপাশি হোটেলটিকে নতুন করে সাজানো ও অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন।
শিকড় বাংলাদেশে
কাজী হাসানদের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। তবে বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা কাজী শাহাবউদ্দীন, মা জ্যোৎস্না বেগম। তাঁরা দুই ভাই ও এক বোন। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০০২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। স্ত্রী ফারজানা আর ছয় বছরের মেয়ে সামারা কাজীকে নিয়ে ছোট সংসার। থাকেন সিঙ্গাপুরে।
রান্নাশিল্পের কদর বাড়ুক
দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রান্নাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কাজী হাসান। বিদেশের বিখ্যাত সব হোটেলে ‘সেরাদের সেরা’ হয়ে কাজ করেছেন। অনেকেই তাঁকে প্রশ্ন করেন, রান্নাশিল্পে সফল হতে কী করতে হবে। কাজী হাসান বলেন, ‘শুরুতেই নিজের পথ ঠিক করতে হবে। যাঁরা সত্যিকার অর্থেই রান্নাশিল্পে আসতে চান, তাঁদের প্রথমে উচিত এ বিষয়ে পড়াশোনা করা। মনে রাখতে হবে, অন্য পেশার মতো এ পেশাতেও পড়াশোনার গুরুত্ব সবার আগে। শিক্ষিত ও দীক্ষিত—দুটিই দরকার নিজেকে এই পেশায় আলোকিত করতে।’