আমাদের শৈশব হারিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক খেলা। এখন সেসব খেলার কথা মনে হলে খেলার সঙ্গীদের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড় শৈশবের হারিয়ে যাওয়া খেলা আর স্মৃতির কথা। আমরা উদাস হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও।
‘শৈশব’ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা ধূসর গল্পের জগৎ সামনে চলে আসে। নির্ভার, চিন্তাহীন একটা সময়। কত কীই–না করেছি আমরা সে সময়! কত গল্প, কত দুষ্টুমি আর কত খেলা। যাঁরা এখন এই লেখার পাঠক, তাঁদের শৈশবের স্মৃতি এখন বেশ খানিকটা ফিকে হয়ে গেছে। শৈশবের কথা উঠলেই এখন খেলার সঙ্গী, খেলা, খেলার মাঠ আর কত হাজারো রকমের স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে। খেলার সঙ্গীরা এখন কে কোথায়, সেটা জানা নেই। কিন্তু খেলার স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে। চলুন আরেকটু উসকে তোলা যাক সেই স্মৃতি।
লাটিম
লাটিম বা লাট্টু আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটি শিশুতোষ খেলা। লাটিম খেলতে পারে না, এ রকম মানুষ খুব কম আছে আমাদের সমাজে। ছেলেবেলার অত্যন্ত প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। এটি শুধু খেলাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছেলেবেলার বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি, মায়ের মাটির ব্যাংক ভেঙে টাকা চুরি করে রঙিন লাটিম কেনার একরাশ স্মৃতি। নতুন কেনা রঙিন লাটিম দিয়ে কাউকে হারিয়ে দেওয়ার যে সুখস্মৃতি, তা এখনো চোখে লেগে আছে। উল্টো দিকে, একের পর এক ‘শত্রু’দের লাটিমের হামলায় চোখের সামনে নিজের রঙিন লাটিম ক্ষতবিক্ষত হতে দেখার স্মৃতি এখনো আমাদের পীড়িত করে নিজের অজান্তেই।
গুলি বা মার্বেল
কাচের ছোট্ট গোলাকার কালচে সবুজ মার্বেল খেলেনি কে? সে ধরনের মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। কী যে এক উদ্দাম নেশা ছিল কারও কারও এই মার্বেল খেলার প্রতি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। পকেটে বা কোঁচড়ে মার্বেল নিয়ে ঘুমানোর সেসব দিনের কথা মনে পড়লে নিজের অজান্তে উদাস হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে এখন! স্কুল ছুটি হলে বা স্কুল পালিয়ে মার্বেল কিনতে যাওয়া, বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে পিটুনি খাওয়া বা একবেলা খাওয়া বন্ধ—সেসব দিন কেবলই স্মৃতিকাতর করে তোলে আমাদের।
গুলতি
ভরদুপুরে পুরো এলাকা যখন শান্ত, নিশ্চুপ, পকেটে গুলতি বা বাটুল নিয়ে এক দৌড়ে পাশের বাঁশবন বা পুরোনো কোনো গাছের নিচে উপস্থিত হওয়া, তারপর টার্গেট প্র্যাকটিস। গ্রাম হোক অথবা শহর, গুলতি বা বাটুলে টার্গেট প্র্যাকটিস অথবা পাখি শিকার ছিল শৈশবের রঙিন স্বপ্ন বাজির অন্যতম অনুষঙ্গ। যাঁরা প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এরশাদের স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন দেখেছেন, তাঁদের স্মরণ থাকার কথা এই গুলতির বিকল্প ব্যবহার। মিছিলে পুলিশের ধাওয়া আসার সময় শৈশবে ব্যবহার করা এই যন্ত্র অনেকেই ব্যবহার করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। সাইকেলের টিউব অথবা ইলাস্টিক এবং গাছের ডাল দিয়ে বানানো এই যন্ত্র এখন আর খুব একটা দেখা যায় না।
গোল্লাছুট
বিকেলবেলা খোলা মাঠে হইচইয়ের মধ্যে খেলা হচ্ছে গোল্লাছুট। পাড়ার সবাই উপস্থিত। কী করতে হবে আর হবে না, তা নিয়ে খেলোয়াড়দের চেয়ে দর্শকদের চিন্তাই যেন বেশি। এরই মধ্যে দৌড় দিল কোনো এক খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে। সফল হলে বিশাল উল্লাসধ্বনি আর বিফল হলে আফসোসের সুর। এই খেলার সঙ্গেই যেন জড়িয়ে আছে আমাদের রঙিন শৈশবের গল্প। গোল্লাছুট ছাড়া আমাদের শৈশবের গল্প ঠিক জমে না। কিশোর-কিশোরীনির্বিশেষে এই খেলা হয়ে থাকে। দুই দল খেলোয়াড়। এক দল হাতে হাত ধরে পালানোর পথ খুঁজছে। অন্য দল ধরে ফেলার চেষ্টা করছে। ভীষণ উত্তেজনার সে খেলা। খেলার মাঠ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে গোল্লাছুটও হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে।
কানামাছি
‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’—ভরদুপুরের অবসরে এখনো কানে বাজে এই সুর। এক অলৌকিক মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে। সময় হয়তো কিছুটা আটকে যায়। অথবা আমরাই আটকে যাই ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’র মাদকতায়। ফিরে যাই নির্মল শৈশবের দিনগুলোয়। বিকেলের চুরিয়ে যাওয়া আলোয় একদঙ্গল ছেলেমেয়ে চোখ–বাঁধা কানামাছিকে ‘টুকি’ দিতে দিতে সুর করে গলা ছেড়ে গাইছে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ’। অথবা স্কুলের টিফিনের স্বল্প সময়ে একই দৃশ্যের পুনরাবর্তন। কানামাছি একজনকে ছুঁয়ে দিল, তো নতুন এক কানামাছির জন্ম হলো। এভাবে একের পর এক কানামাছির পরিবর্তন। কিন্তু সুর ও ছন্দ অপরিবর্তনীয়। আপনার বয়স যা–ই হোক না কেন, হারজিতের প্রশ্নহীন কানামাছি খেলার সেই ছন্দ ও সুর আপনাকে এখনো স্মৃতিকাতর করে তুলবেই।
দাঁড়িয়াবান্ধা
প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে একটা একটা করে ধাপ পেরিয়ে যাওয়া! প্রতিটি ধাপে ধূর্ত শেয়ালের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। দুরন্ত শৈশবের উত্তেজনাকর খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা।
গ্রামের অত্যন্ত জনপ্রিয় শারীরিক পরিশ্রমের এই খেলা। বিকেলবেলা হইহল্লা হবে, হারজিত নিয়ে ঝগড়া হবে, এই না হলে খেলা! দাঁড়িয়াবান্ধা তেমনই একটি খেলা। ছোট ছোট কোর্ট বানিয়ে খেলা হতো। বিভিন্ন এলাকায় একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এবং অঞ্চলভেদে এর নিয়মকানুনেও ভিন্নতা থাকে। কিন্তু মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে গিয়ে পয়েন্ট বাগানোই এই খেলার মূল উদ্দেশ্য। তাই এই খেলায় থাকে উত্তেজনা। ধান কাটা হয়ে গেলে এই খেলার আসর বসত খোলা মাঠে। অবশ্য গ্রামীণ স্কুলগুলোর মাঠেও থাকত দাঁড়িয়াবান্ধার কোর্ট। এখন এটি খুব একটা খেলা হয় না।
জোলাপাতি
খুব ছোটবেলায়, যখন আপনি টাকাই চেনেন না, তখন কি বাজার করেছিলেন? কিংবা যখন ভাত রান্না করতে পারার কথা নয়, তখন ভাতের হাঁড়ি চুলায় তুলেছিলেন? কিংবা একদঙ্গল ছেলেমেয়েকে হাঁড়ি থেকে খাবার বেড়ে দিয়েছিলেন? এখন যখন আপনি নিজেই সংসারে ব্যস্ত, তখন হয়তো আপনার সেসব কথা ভেবে দেখার সময়ই নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায়, ঘরের কোণে, গাছতলায় আপনি সেই শৈশবে আপনার সংসার সাজিয়েছিলেন খেলার ছলে! সে কী ব্যস্ততা আপনার! মনে পড়ে? হয়তো আপনার সন্তান সঙ্গীর অভাবে এখন সে খেলা আর খেলতে পারে না।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, বড়রা যা করে, ছোটরা তা–ই শেখে। জোলাপাতি খেলা ছোটদের ‘বড় খেলা’! জোলাপাতি বললে অনেকেই এই খেলাকে নাও চিনতে পারেন। কিন্তু ‘হাঁড়িপাতিল’ বা ‘বউ বউ’ বললে চিনতে পারবেন সহজেই। শিশুদের স্বপ্নের সংসার এই জোলাপাতি। ভবিষ্যতে সে যে সংসারে প্রবেশ করবে, এই খেলা যেন তারই ‘পাকা তালিম’।
ডাংগুলি
একজন ব্যাটসম্যান, চারদিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে চার বা পাঁচজন ফিল্ডার। অবাক হচ্ছেন? এটা ক্রিকেট নয়, ক্রিকেটের আমাদের সংস্করণ ডাংগুলি খেলা। খেলেছেন নিশ্চয়ই। হয়তো গুলির আঘাতে কপাল বা মাথা কেটে যাওয়ার চিহ্নও আছে আপনার শরীরে। ডানপিটে আর দুর্ধর্ষ বালকদের খেলা ছিল এই ডাংগুলি। দেড়–দুই ফুটের লম্বা ডাং বা লাঠি আর দুই–আড়াই ইঞ্চির ছোট লাঠি দিয়ে খেলা হতো এই ডাংগুলি। ক্রিকেটের মতোই। একজন ছোট লাঠি বা গুলিটিকে ছুড়ে দিচ্ছে ডাং বা লাঠি ধরে থাকা খেলোয়াড়ের দিকে। সে ক্রিস গেইলের মতো পিটিয়ে সেটাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে যত দূরে সম্ভব। আবার মাটিতে পড়ার আগে ধরে ফেললেই ব্যাটসম্যান আউট। মনে পড়ছে কি আপনার শৈশবে খেলা দেশীয় ক্রিকেটর কথা? অঞ্চলভেদে এই খেলার নিয়মকানুনেও ভিন্নতা আছে।
যত ব্যস্তই থাকুন আর যেখানেই থাকুন না কেন, শৈশবস্মৃতি আপনার পিছু ছাড়বে না। খেলতে পারার মতো বয়স বা সুযোগ কোনোটাই আপনার এখন নেই হয়তো; কিন্তু গল্পটা তো বলতে পারেন আপনার সন্তানকে। বলুন না আপনার শৈশবের কথা। এই বয়সে নির্ভার হওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর কী হতে পারে?