সৌরভ গাঙ্গুলী কীভাবে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে বদলে দিয়েছিলেন

অধিনায়কত্ব পাওয়ার পরপরই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে বদলে দিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। নেতৃত্বের কৌশল খুব ভালো জানেন এই বাঙালি ক্রিকেটার। অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় কী ছিল তাঁর ভাবনার জগতে? এ প্রসঙ্গে সৌরভ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন দ্য ইকোনমিক টাইমস। পড়ুন সেই লেখার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

সৌরভ গাঙ্গুলী

২০০০ সালে আমি যখন প্রথম ভারতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব নিলাম, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, সাংবাদিক বন্ধু আমাকে মাইক ব্রিয়ারলির সেই বিখ্যাত বইটা উপহার দিয়েছিল—দ্য আর্ট অব ক্যাপ্টেনসি। বইটার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, বই কিংবা ‘টিম মিটিং’ কখনোই আপনাকে ভালো অধিনায়ক বানাবে না। অধিনায়কত্ব আমি তত্ত্বীয় জ্ঞান থেকে শিখিনি, চর্চা করে শিখেছি।

আমি নিজের মতো করে নেতৃত্ব দিয়ে নিজের মতো করেই সাফল্য পেতে চেয়েছি। জানতাম, আমরা খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। টানা পরাজয় তো বটেই, গণমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো নানা রকম গালগপ্প সময়টাকে কঠিন করে তুলেছিল। দল এবং কয়েকজন খেলোয়াড় সম্পর্কে নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। ম্যাচ ফিক্সিং ব্যাপারটা সে সময়ই অন্ধকার থেকে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। পুরো দলটাই যখন হতোদ্যম, তাদের অনুপ্রাণিত করা সহজ ছিল না। জানতাম, আমার কাজটা খুব কঠিন। পরে বুঝেছি, কঠিন সময়ই নায়ক তৈরি করে।

ঠিক করেছিলাম, যে করেই হোক দেশের বাইরের টুর্নামেন্টগুলোতে আমাদের ভালো করতে হবে। সে সময় দেশের মধ্যে আমরা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছি, খুব ভালো ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু আমি জানতাম, বিদেশে জয় পাওয়ার মর্ম আলাদা। হোক সেটা দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড। আমরা তখন স্পিনের জাদুতে প্রতিপক্ষকে কাবু করতাম। কিন্তু বিদেশের মাটিতে খেলা হলেই প্রতিপক্ষ দলগুলো শুকনো, খটখটে পিচ বানাত আর আমাদের নির্বিষ স্পিন উপভোগ করত। ফলে আমাদের প্রধান অস্ত্রটাই অকার্যকর হয়ে যেত। অধিনায়ক হওয়ার পর শুরুতেই আমি বলেছিলাম, এই পুরোনো কৌশল বদলাতে হবে।

আমি চেয়েছিলাম একদল তরুণ, শক্তিশালী ফাস্ট বোলার। এই উপমহাদেশে স্পিনাররা নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু উপমহাদেশের বাইরে সব কটি উইকেট তুলে নেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে পেস বোলারদের। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারেরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ওরা জেতার জন্যই মাঠে নামত। আমিও আমার দলে এই চেতনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। হারলে ক্ষতি নেই, কিন্তু জেতার প্রাণপণ চেষ্টা যেন থাকে।

নতুন করে দলটাকে সাজাতে প্রায় এক বছর সময় লেগেছে। ২০০২ সাল আমার জন্য সাফল্যের বছর ছিল। কলম্বোয় অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আমরা ভালো খেলেছি। একদিন এক সাংবাদিক বললেন, ওয়াসিম আকরাম নাকি ভারতীয় দলের এই নতুন চেহারার প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচে যেভাবে আমরা হারতে হারতে ফিরে এসেছি, আকরামকে সেটা মুগ্ধ করেছে। তাঁর নাকি মনে পড়ে গেছে আশির দশকের পাকিস্তান দলের কথা। যে দল কখনো ভাবতেই পারত না তারাও হারতে পারে! এ কারণেই ওই দল বেশ কয়েকটি ম্যাচে খুব খারাপ অবস্থাতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমার জন্য এই প্রশংসা অনেক বড় ছিল। কীভাবে এমন একটা দল তৈরি করেছিলাম? এটা কিন্তু প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মেধার জোরে হয় না। বরং পুরো দলেই জয়ের চেতনা গড়ে উঠেছিল। আমার অধিনায়কত্বের ভিত ছিল দুটি। মেধার মূল্যায়ন করা এবং তরুণ খেলোয়াড়েরা যেন নির্ভয়ে খেলাটা খেলে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা।

যখন আমি একজন খেলোয়াড়কে বেছে নিতাম, আমি পুরো যাত্রায় তার পাশে থাকতাম। একজন তরুণ খেলোয়াড় যদি দলে তার জায়গা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়, কীভাবে সে পারফর্ম করবে? সে কি কখনো ঠান্ডা মাথায় তার সেরাটা দিতে পারবে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি এটা শিখেছি। যখন মাত্রই দলে জায়গা পেয়েছি, আমি টিকতে পারব নাকি আমাকে বাদ দেওয়া হবে, এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগতাম। এই দুশ্চিন্তাই মাঠে আমাকে খেয়ে ফেলত। অতএব অধিনায়ক হওয়ার পর প্রথমেই আমি এই সমস্যা দূর করতে মনোযোগী হয়েছি।

তরুণ খেলোয়াড়দের আরও বেশি অনুপ্রাণিত করার জন্য আমি একটা মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ব্যবহার করতাম। মাঠের বাইরে আমি ছিলাম খুব চুপচাপ, আত্মকেন্দ্রিক, নিরীহ। কিন্তু মাঠে নামলেই আমি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতাম। অপ্রত্যাশিতভাবেই এই কৌশল শিখেছিলাম ২০০১ সালে ইডেন গার্ডেনের সেই বিখ্যাত টেস্ট ম্যাচ খেলার সময়। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ একটা ম্যাচ চলছিল। খেয়াল করলাম, অস্ট্রেলীয়রা যতটা আক্রমণাত্মক ভাব দেখাচ্ছে, আমার দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ও সমানতালে সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছে।

মাঠে নামলেই বদলে যেত গাঙ্গুলীর শরীরী ভাষা

ঠিক করেছিলাম, ভবিষ্যতেও এই পদ্ধতি কাজে লাগাব। ইচ্ছে করেই আমি প্রতিপক্ষের সঙ্গে একটা ঝগড়া বাধিয়ে দিতাম, হরভজন সিং আর জহির খানকে খেপিয়ে তোলার জন্য। আমাদের কোচও সফলভাবে আমার ওপর একই কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। ২০০২ সালে ন্যাট-ওয়েস্টের সেই বিখ্যাত ফাইনাল ম্যাচের আগে আমার সঙ্গে জনের (জন রাইট) কী যেন একটা বিষয় নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল। আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ম্যাচ জেতার পর আমরা যখন উৎসব করছি, হঠাৎ কাঁধের ওপর কারও প্রশংসামাখা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ফিরে দেখি আমাদের কোচ। তিনি হেসে বললেন, ইচ্ছে করেই আমার সঙ্গে একটা ঝগড়া বাধিয়েছিলেন আমাকে খেপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। সেই ম্যাচে আমি ৪৩ বলে ৬০ রানের একটা ঝোড়ো ইনিংস খেলেছিলাম।

জয়ের লড়াই আসলে যতটা না মাঠে বা মাঠের বাইরে হয়, তার চেয়ে বেশি চলে মাথার ভেতর। অধিনায়কের কাজ হলো মাথার ভেতরে জয়ের চেতনা ঢুকিয়ে দেওয়া। এ কারণেই গ্রেগ চ্যাপল ভারতে সফল হতে পারেননি। জয়ের পরিবেশ তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। তাঁর অধীনে দলটা নেট অনুশীলনে কঠোর পরিশ্রম করেছে, মাঠে যা করা দরকার করেছে, সবাই নিয়ম–শৃঙ্খলা মেনেছে। কিন্তু ভিনদেশের মাটিতে টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে এসব যথেষ্ট নয়। কোনো একজনকে কাঁধে হাত রেখে বলতে হয়, তুমি যেহেতু একবার পেরেছ, আবারও পারবে; ভয়ের কী আছে? চ্যাপলের ‘টিম ইন্ডিয়া’র মধ্যে এই শক্তি, এই লড়াকু মনোভাবেরই ঘাটতি ছিল।

অধিনায়কত্ব একটা প্রচণ্ড মানসিক চাপের কাজ। এম এস ধোনিকে দেখুন। বেচারার গায়ের রং ধূসর হয়ে গেছে। আমাকে দেখুন। একগাদা মাথার চুল হারিয়েছি। যখন আপনি বাধা ভাঙতে চাইবেন, লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন, মর্যাদা ধরে রাখার লড়াইয়ে নামবেন, চাপ আপনার সঙ্গী হবেই। আমার ক্যারিয়ারে চাপ কখনো কখনো অসহনীয় ঠেকেছে। তবু কখনো এই চাপ থেকে পালাতে চেষ্টা করিনি। পেশাদারির নিয়ম হলো, আপনি যখন জয়ের যুদ্ধে নামবেন, শত চাপকেও ভয় না পেয়ে স্বাগত জানাতে হবে।

প্রত্যেকেরই চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নিজস্ব কিছু পদ্ধতি থাকে। আমার ক্ষেত্রে সেটা হলো গান। নিজস্ব মিউজিক সিস্টেম নিয়ে আমি একটা টুর্নামেন্ট খেলতে যেতাম। আমার সংগ্রহ খুব সমৃদ্ধ—কিশোর কুমার থেকে শুরু করে কুমার শানু, আশা ভোসলে থেকে অভিজিৎ। সনু নিগম থেকে শান। লতা মঙ্গেশকরের প্রতি একটা আলাদা ভালো লাগা তো আছেই। মনকে শান্ত রাখতে চাইলে আপনারও কোনো না কোনো নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করা উচিত।

নেতৃত্ব হলো একটা অদ্ভুত রোগ। হয় এটা আপনাকে সারিয়ে তুলবে, নয়তো মেরে ফেলবে। অধিনায়কত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি অনেক মানুষকে বদলে যেতে দেখেছি। দলের হাল ধরার পর একটু একটু করে বদলে গেছে অনেকের ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আপনি যদি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন, প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে বুঝবেন এটাই পৃথিবীর সেরা কাজ! (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনূদিত