বুদ্ধদেব বসু ‘সমুদ্রস্নান’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘একবার নিজেকে দাও না সমুদ্রের কাছে/ তারপর দ্যাখো সে তোমাকে নিয়ে কী করে।’ কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ হামদান চৌধুরী নিজেকে সমুদ্রের কাছে দিয়েছেন। হাঙর গবেষক ও আন্ডারওয়াটার ভিডিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন বিহাইন্ড দ্য মাস্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে। তিনি শোনালেন গভীর সমুদ্র আর হাঙরের সঙ্গে মিতালির গল্প।
গত নভেম্বরের এক সকালে ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল করতে করতে নিচে নামছিলাম। হঠাৎ একটি ভিডিও দেখে থামতে হলো; কিংবা ডুব দিতে হলো বলা যায়। সমুদ্রের নীল জলরাশিতে একজন ক্যামেরা হাতে স্থির হয়ে আছেন, তাঁর আশপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক হাঙর! ব্যাপারটি যেন এমন—অ্যাকুরিয়ামে মাছের ভিড়ে নিঃসঙ্গ এক খেলনা ‘ডুবুরি’ বুদ্বুদ তুলে যাচ্ছে! ভিডিওটি আপলোড করেছেন হামদান চৌধুরী নামের একজন। একে তো রোমাঞ্চকর ভিডিও, তার ওপর বাংলা নাম—দুই কারণে প্রোফাইলে ঢুকতে বাধ্য হলাম। দেখতে লাগলাম একের পর এক ভিডিও আর ছবি। সবই সমুদ্রের নিচের দৃশ্য। অধিকাংশই আবার হাঙর নিয়ে। দ্রুতই ফেসবুকে হামদান চৌধুরীকে খুঁজে বের করার পর নিশ্চিত হওয়া গেল, এই তরুণ বাংলাদেশি। কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম, হামদান পেশায় আন্ডারওয়াটার ভিডিওগ্রাফার এবং হাঙর গবেষক। সমুদ্রবাসী হাঙরের সঙ্গে অদ্ভুত সব মিতালির গল্প আছে এই ডাঙাবাসীর ঝুলিতে।
২.
হামদান চৌধুরী এ পেশায় কবে, কীভাবে, কেন এলেন—এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে একটা গল্প শুনুন। বছর চার–পাঁচেক আগের কথা। হামদান তখন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে পড়ছেন। অনেক দিন ধরেই সমুদ্রে ডাইভিং করেন। তাই একটি দোকানে গেছেন ডাইভিং ফিন কিনতে। টাকা পরিশোধ করার সময় খেয়াল করলেন কাউন্টারের টিভিতে হাঙর নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র চলছে। পানির নিচে ড্রোন দিয়ে শুট করা ভিডিওটিতে দেখানো হচ্ছে গ্রেট হ্যামারহেড হাঙরের শিহরণ–জাগানিয়া সব দৃশ্য। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন হামদান। ছেলেবেলা থেকেই গ্রেট হ্যামারহেড তাঁর প্রিয় প্রজাতি। ভিডিওটি বানিয়েছে বিহাইন্ড দ্য মাস্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। হামদান তখন ভাবেনওনি, একসময় এই প্রতিষ্ঠানেই কাজ করবেন তিনি। গত বছরের এপ্রিল মাসে বিহাইন্ড দ্য মাস্কের আন্ডারওয়াটার ভিডিওগ্রাফার হিসেবে বাহামায় গিয়েছিলেন হামদান। সমুদ্রের রহস্যময় জগতে ডুব দেওয়ার পর আবিষ্কার করেছিলেন, চোখের সামনে রাজকীয় ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে তাঁর প্রিয় গ্রেট হ্যামারহেড হাঙর!
ছেলেবেলা থেকেই নিজেকে সমুদ্রের কাছে সঁপে দিয়েছেন হামদান চৌধুরী। ১৯৯০ সালে জন্ম সিঙ্গাপুরে, ১৮ বছর ছিলেন বাংলাদেশে। তারপর চলে গেছেন কানাডায়। কৈশোরে ছুটির দিনগুলোতে প্রায়ই যেতেন যুক্তরাষ্ট্রে। আটলান্টিকের জলে পা ভেজানো ফ্লোরিডাই তাঁকে বারবার ডাকত। সমুদ্রে ডুবুরির সনদ পেয়েছিলেন তখনই। ফলে ছুটির অধিকাংশ দিনই কাটিয়ে দিতেন সমুদ্রের নীল জলে ডুব মেরে। সমুদ্রের এই নেশা পেয়ে বসেছিল মায়ের কিনে দেওয়া কতগুলো বই পড়ে। হামদান বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় অনেক বই পড়তাম। বিশেষ করে সমুদ্র আর হাঙরবিষয়ক বই পেলে নাওয়া–খাওয়া ভুলে যেতাম। কানাডা থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছিলাম। পারিবারিক ব্যবসাই হয়তো দেখতে হতো। কিন্তু সমুদ্রের টানেই আবার কানাডায় চলে এলাম।’
৩.
সমুদ্রের বুকেই কাজ খুঁজে নিলেন হামদান—পাবলিক সেফটি ডাইভার হিসেবে। সেই কাজ করতে করতেই ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক হাঙর গবেষকের সঙ্গে পরিচয়। সেই পরিচয় তাঁকে নিয়ে গেল বাহামায় হাঙর–দুনিয়ার আরও গভীরে। সাধারণের চোখে হিংস্র হাঙর নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন হামদান। আগে থেকে জানতেন, তবে গবেষণায় জড়িয়ে যাওয়ার পর গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, ‘মিডিয়া হাঙরকে যেভাবে দেখায়, আসলে তা ভুল। হ্যাঁ, এটা ঠিক, হাঙর মোটেও নিরীহ প্রাণী নয়। কিন্তু সিনেমায় যেভাবে দেখানো হয়, তেমনটাও নয় আসলে। মেরিন ইকো সিস্টেম ঠিক রাখতে হাঙর রক্ষা করা ভীষণ জরুরি। বাহামায় অনেক প্রজাতির হাঙর আছে। দেশটির সরকার হাঙর রক্ষার জন্য দারুণ আন্তরিক। ফলে মনপ্রাণ ভরে গবেষণার কাজ করতে পেরেছি।’
কিন্তু সেটাতে বাগড়া দিলেন স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প! ২০১৬ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে হাঙর গবেষণায় বরাদ্দ কমিয়ে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ঠিক সে সময় হামদানদের গবেষণা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে এল বিহাইন্ড দ্য মাস্ক নামের প্রতিষ্ঠানটি। সামুদ্রিক প্রাণী নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে এরা ওস্তাদ। সারা বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পেয়েছে একাধিক পুরস্কার। হামদান ভাবতেও পারেননি, ওরাই গবেষণা সহকারী এবং আন্ডারওয়াটার ভিডিওগ্রাফার হিসেবে ডাকবে তাঁকে। স্বপ্নের এক কাজ পেয়ে গেলেন হামদান। অতিকায় অজগর, কুমির, বিশেষ করে হাঙরের সুলুক সন্ধানে ডুব দিতে লাগলেন মেক্সিকো, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মোজাম্বিকসহ আরও নানা দেশের সমুদ্রে। হামদানের বেশির ভাগ কাজ অবশ্য বাহামাতেই।
৪.
ওই বাহামাতেই একবার ভীষণ বিপদে পড়েছিলেন। হামদানের ভাষায়, ‘ওই একবারই বিপদে পড়েছিলাম। হাঙরের খোঁজে গেলে আমরা অনেক মাছ নিয়ে যাই। মাছ ছড়িয়ে দেওয়ার পর দেখি, বেশ কটা টাইগার শার্ক ছুটে এল। তখন আমি আনাড়ি, তাই একবারে বেশি বেশি মাছ দিচ্ছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে খেয়াল করলাম, আমার মাছ শেষ। টাইগার শার্ক তো সেটা বোঝার পাত্র নয়! ওর পেটে রাজ্যের খিদে। মাছ না পেয়ে বার দুয়েক আমার আশপাশে ঘুরে বিরক্ত হয়ে গেল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। টাইগার শার্ক বাঘের মতোই বিপুল খিদে নিয়ে ছুটে এল আমার দিকে। শেষ মুহূর্তে প্রাণপণে সাঁতরে বোটে ফিরে এলাম আমি। ভাবলেই ঘাম ছুটে যায়!’
প্রাণ হাতে নিয়ে এই কাজ যে করছেন, আপনার পরিবার কী বলে? সন্তানকে জলে নামতে দেওয়ার আগে মা–বাবা নিশ্চয়ই চোখের জল ফেলেছিলেন? হামদানও তেমনটাই বললেন, ‘আমি বরাবরই পানির পোকা। ডাইভিংয়ে তাঁদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু হাঙর নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ছিল প্রবল আপত্তি। ভিডিও দেখিয়ে, বই পড়িয়ে তাঁদের বোঝাতে হয়েছে। অবশেষে অনুমতিও পেয়েছি। এখন তাঁরা বরং উৎসাহই দেন। আমার কাজ নিয়ে গর্ব করেন।’
৫.
গত বছরের নভেম্বরে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন হামদান। সেখানে জেলেদের শিকারে পরিণত হওয়া হাজার হাজার হাঙর দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতাও জানেন তিনি, ‘ওই জেলেদের তো কিছু করার নেই। এটাই তাঁদের পেশা। আবার এই হাঙরগুলো মারা পড়লে আমাদের মেরিন ইকো সিস্টেম ঠিক থাকবে না। তাই ওই জেলেদের নিয়েই হাঙর রক্ষায় কাজ করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। বাংলাদেশের বেশ কজন গবেষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে আমার। তাঁরা দারুণ আন্তরিকতার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।’
সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের প্রজননক্ষেত্র রক্ষায় সুন্দরবনের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওয়াইল্ড কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরের ওই এলাকাটি তিমি, হাঙর আর ডলফিনের মতো সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র। হামদানের স্বপ্ন, বঙ্গোপসাগরের ওই অতল গভীরে ডুব দেবেন, মিতালি হবে হাঙর, তিমি আর ডলফিনদের সঙ্গে।
মনে পড়ে রুশ সাহিত্যিক আলেক্সান্দার বেলায়েভের বিখ্যাত উভচর মানুষ বইয়ের কয়েকটি লাইন। যেখানে প্রধান চরিত্র উভচর মানুষ ইকথিয়ান্ডর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘…হাসে ইকথিয়ান্ডর, চেপে ধরে ডলফিনদের, সাঁতরায়, ডুব দেয় এদের সঙ্গে। তার মনে হয় এই সমুদ্র আর ডলফিন, এই আকাশ আর সূর্য যেন তার জন্যই গড়া।’
হামদান চৌধুরীর ভিডিওগুলো দেখা যাবে ইনস্টাগ্রামে—
https://bit.ly/2BuG2pN