‘এজ ক্যাননট ওয়েদার হার’ শেক্সপিয়ার লিখেছিলেন রানি ক্লিওপেট্রাকে উদ্দেশে। সত্যি, বয়স তাঁকে বিবর্ণ করতে পারেনি! আর বিবর্ণ করতে না পারার পেছনে ছিল রানির প্রতিদিনের প্রসাধনচর্চা। প্রসাধনের সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক থাকলেও এতে নারীদের অধিকার নিরঙ্কুশ। যেকোনো বিচারের জরিপে প্রসাধনের ক্ষেত্রে বিজয়ী হবেন তাঁরাই। সৌন্দর্যচর্চার দুনিয়ায় তাই পণ্যের শুভেচ্ছাদূত বা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের পদটি থেকে গেছে নারীদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে। এ জন্যই হয়তো কৃষ্ণ কিংবা হেক্টরের মতো আকর্ষণীয় পুরুষদের যুদ্ধক্ষেত্রে মাথা কুটে মরতে হয়েছে। আর শত শত বছর পরও এক কিংবদন্তির রূপের কথা লিখে রাখতে হয়েছে শেক্সপিয়ারকে, মৃত্যুর কয়েক শ বছর পরের পাঠকের জন্য।
যা–ই হোক, প্রসাধনচর্চার রাজ্যপাটে নারীদের একচ্ছত্র অধিকার। এ রাজ্যের রাজা-রানি-উজির-নাজির সবই তারা। খেয়াল করে দেখুন, আমাদের নানা-দাদারা যখন শীতকালে দুহাতের তালুতে শর্ষের তেল ডলে নিয়ে পুরো শরীরে মেখে ঘুরে বেড়াতেন, তখন নানি-দাদিরা ব্যবহার করতেন কাঁচা হলুদ, মেহেদি পাতা, সুবাসিত নারকেল তেল ইত্যাদি। ব্যাপারটা এ রকম নয় যে, নারী বলেই তাঁরা সৌন্দর্যচর্চার প্রথম ধাপ হিসেবে প্রসাধন চর্চা করতেন। বরং ব্যাপারটা অনেক বেশি প্রাকৃতিক ও বায়োলজিক্যাল। আমাদের কাজ জীববিজ্ঞানের বয়ান দেওয়া নয়। তাই বরং আমরা খানিক ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করি আমাদের প্রসাধনচর্চার অন্তঃপুরের গল্প।
আজকের মতো রাসায়নিক উপাদানে তৈরি প্রসাধনীর চল ক্লিওপেট্রার আমলে ছিল না, এটা বলা যায়। তাহলে কী ব্যবহার করতেন তিনি? ক্লিওপেট্রার বিষয়ে সবচেয়ে বাজার–চলতি গল্প হলো, তিনি স্নান করতেন দুধে। বিজ্ঞান বলছে, দুধের ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের মৃত কোষ তুলে ফেলে তার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে তোলার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ত্বক বিশেষজ্ঞ সোনম যাদব জানাচ্ছেন, এখনো পরিশুদ্ধ ও গাঢ় ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করে ত্বকের উজ্জ্বলতা ও লাবণ্য বাড়ানোর বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরি করা হয়। প্রতিদিনের প্রসাধনের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হোমরিমেডি। অর্থাৎ বাড়িতে হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, সেসব টোটকা। সেগুলো ব্যবহার যে বিজ্ঞান–অসম্মত নয়, সেটা বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানের এই কচকচানির আমদানি করা হলো।
নারীরা হোমরিমেডির ব্যবহারিক শিক্ষা পায় অনানুষ্ঠানিকভাবে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। মেহেদি পাতা, ডিম, ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা), নিমপাতা, লেবুর রস, মধু, জলপাই তেল, ক্যাস্টর অয়েল, দুধ, টক দই, আমলকী, জবা-গোলাপ ফুল, বিভিন্ন মসলা, ফল, সবজি, রসুন-পেঁয়াজ ইত্যাদি কী নেই হোমরিমেডির তালিকায়? এগুলোর আবার একেকটির একেক রকম কাজ। কোনোটি চুল কালো ও উজ্জ্বল করে, কোনোটি চুল করে মসৃণ, কোনোটি আবার ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে তোলে, কোনোটির ব্যবহারে ত্বক হয়ে ওঠে মসৃণ, কোমল। যেমন, লং বা লবঙ্গ ও লেবু মাথার ত্বকের সংক্রমণ দূর করে চুল গজাতে সহায়তা করে। মেথি খুশকি দূর করে, জবা ফুল চুলকে ঝলমলে মসৃণ করে চুলের বৃদ্ধি ঘটায়। গোলাপের পাপড়ির ব্যবহারে ত্বকে ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। একই কাজ করে হলুদ। এ জন্য বোধ হয় বিয়ের আগে নারী ও পুরুষ উভয়কেই গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়, যেখানে বর ও কনের গায়ে ঘটা করে মাখানো হয় হলুদ। এমনও ধারণা করা হয়, কাঁচা হলুদ ও দুধ একত্রে জ্বাল দিয়ে সেই দুধ নিয়মিত পান করলে ত্বকে পাওয়া যায় গোলাপি আভা!
এখানে বলে রাখা অসংগত হবে না যে, বাঙালি মানসিকতা ও অভ্যস্ততায় প্রসাধন অর্থ শুধু ত্বকের চর্চা বোঝালেও মূলত এটি সৌন্দর্যচর্চার সার্বিক প্রক্রিয়াকে বোঝায়। এখানে ত্বকের চর্চা যেমন আছে, তেমনি আছে চুলের যত্ন, আছে বসনভূষণ পরিধান। তেমনি সালংকরা হওয়াও প্রসাধন শব্দটির সঙ্গে যুক্ত। ফরাসি শব্দ ‘তয়লেত’ (টয়লেট নয়) এর সরল বাংলা আমরা করেছি প্রসাধনকক্ষ। এর কারণ, এই কক্ষে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কাজ যেমন করা যায়, তেমনি করা যায় হালকা সাজগোজ। এই ‘সাজগোজ’ই প্রসাধন নামের কঠিন বাংলা শব্দটির যথার্থ অনুবাদ!
প্রসাধনচর্চা আসলে খুব সহজ। এ জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করার তেমন একটা দরকার নেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বেসন। মুচমুচে বেগুনি বা ফুলুরি ভাজার জন্য এটি যেমন কার্যকর, তেমনি ত্বক পরিষ্কার করার জন্যও এটি চমৎকার। প্রায় সবার রান্নাঘরে বেসন থাকার কথা। রমজান মাস বলে নিশ্চিতভাবেই থাকার কথা। বেসন পানির সঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে রাখুন মিনিট ২০। তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা মধু কিংবা লেবুর রস মেশাতে পারেন। যদি একান্তই বেসন বাসায় না থাকে তো ছোলার ডাল মিহি করে পিষে নিন। তারপর একই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করুন। আসলে বেসন হলো প্রক্রিয়াজাত ছোলার ডালের গুঁড়া। ছোলার ডালও যদি ঘরে না থাকে তাহলে মসুরের ডাল বেটে নিয়েও বেসনের কাজ চালাতে পারেন।
আজকাল ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দায় টবে বৃক্ষরোপণ বেশ জনপ্রিয়। টবে তুলসীগাছ থাকে অনেকের। তাজা তুলসীপাতা তুলে বেটে পেস্ট করে নিন। তাতে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে দিন। তারপর ত্বকে মাখুন। মিনিট দশ বাদে ধুয়ে ফেলুন। ব্যবহারের আগে ও পরের তফাত কাউকে বুঝিয়ে দিতে হবে না। আর একটি সহজ উপায় হলো ডিম। ডিম ভেঙে কুসুম আলাদা করে নিন। সাদা অংশ ব্যবহার করতে পারেন ত্বক ও চুল চর্চার জন্য। এর সঙ্গে মিশিয়ে নিতে পারেন সামান্য পরিমাণ বেসন কিংবা কয়েক ফোঁটা লেবুর রস। সবচেয়ে সহজ হচ্ছে ফলের ব্যবহার। বলা হয়ে থাকে, যেকোনো ফলই আপনি খাওয়ার পাশপাশি রূপচর্চার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
এই করোনাকালে যখন সবাই ঘরবন্দী, তখন হাতের কাছে যা আছে তাকেই কাজে লাগিয়ে ফেলুন আপনার প্রসাধনী হিসেবে। নারীদের মুখে তো বটেই, অনেক পুরুষের মুখেও শুনেছি যে মাঝে মাঝে প্রসাধনচর্চা মানসিক প্রশান্তি দেয়। করোনাকালে মানসিক চাপমুক্ত থাকতে রান্নাঘর ও খাবার টেবিলে যা আছে, তা দিয়েই প্রসাধন চর্চা করে মানসিকভাবে প্রশান্ত থাকুন।