>
টিপু আজিজ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাংশনাল নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে লক্ষাধিক মানুষ পারকিনসনস রোগ থেকে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। সম্প্রতি নিউরোসার্জারিতে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘মেডেল অব দ্য সোসাইটি অব ব্রিটিশ নিউরোলজিক্যাল সার্জনস (এসবিএনএস)’ পেয়েছেন তিনি।
২০০৬ সালের কথা। চিকিৎসা গবেষণায় প্রাণীর ব্যবহার নিয়ে যুক্তরাজ্যে তখন তুমুল বিতর্ক চলছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক প্রাণী ব্যবহারের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিলেন। এতে খেপে গেলেন প্রাণী অধিকার রক্ষা আন্দোলনকারীরা। নিরাপত্তার জন্য পুলিশি পাহারায় থাকতে হলো সেই অধ্যাপককে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের সংযোজন করে তিনি এখন শুধু যুক্তরাজ্য নয়, বিশ্বময় সমাদৃত।
‘বিতর্কিত’ থেকে পুরস্কৃত সেই অধ্যাপক বাংলাদেশেরই সন্তান। পুরো নাম টিপু জাহেদ আজিজ। অধ্যাপক টিপু আজিজ নামেই বেশি পরিচিত। পারকিনসন (নিয়ন্ত্রণহীন হাত-পা কাঁপা বা খিঁচুনি) রোগের চিকিৎসায় তাঁর আবিষ্কার বিশ্বে অনুকরণীয়। মস্তিষ্কের কোষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আরও নানা রোগের সমাধান আবিষ্কারে গবেষণা চালাচ্ছেন এই বাঙালি সন্তান।
টিপু আজিজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাংশনাল নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান। এ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। কেবল অধ্যাপনা আর গবেষণা নয়; অক্সফোর্ডের জন রেডক্লিফ হাসপাতালে স্নায়ু শল্যবিদ (নিউরোসার্জন) হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।
গত ২১ মার্চ ‘সোসাইটি অব ব্রিটিশ নিউরোলজিক্যাল সার্জনস (এসবিএনএস)’ তাঁকে সেরা নিউরোসার্জনের স্বীকৃতি হিসেবে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সোসাইটি অব ব্রিটিশ নিউরোলজিক্যাল সার্জনস (এসবিএনএস) বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো জাতীয় নিউরোলজিক্যাল সমিতির একটি।
২ এপ্রিল টেলিফোনে কথা হলো এই গবেষকের সঙ্গে। কথার সরলতা আর কোমল বাচনভঙ্গি শুনে বোঝার উপায় নেই ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি একজন বিশ্বখ্যাত স্নায়ু শল্যবিদ (নিউরোসার্জন)। প্রায় এক ঘণ্টার ফোনালাপে উন্মোচিত হলেন ভিন্ন একজন টিপু আজিজ। জানালেন, তাঁর কাছে এই স্বীকৃতি সেরা। কারণ, একমাত্র তিনিই কর্মজীবনে থাকা অবস্থায় এই স্বীকৃতি পেয়েছেন। অতীতে যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা অবসর নেওয়ার পর কিংবা মৃত্যুর পর।
টিপু আজিজের জন্ম ঢাকায়, ১৯৫৬ সালে। বাবা মোহাম্মদ এম এ আজিজও ছিলেন চিকিৎসক। আদি বাড়ি ফরিদপুরের রাজবাড়ী উপজেলায়। তাঁরা দুই ভাই, দুই বোন। মা জাহেদা আজিজ সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ১৯৭৩ সালে চাকরি নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তখন টিপু আজিজের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। সেই থেকে অক্সফোর্ড শহরে বসবাস করছেন প্রখ্যাত এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী।
মস্তিষ্ক নিয়েই কাজ
মানুষের মস্তিষ্ক বা মগজ নিয়ে অধ্যাপক টিপু আজিজের কাজ–কারবার। তাঁর গবেষণার প্রথম সাফল্য পারকিনসনের মতো জটিল ও চরম অস্বস্তিকর রোগের সমাধান উদ্ভাবন। পারকিনসন রোগীর শরীর স্থির থাকে না। হাত-পা প্রচণ্ড রকম কাঁপতে থাকায় এসব রোগী হাঁটা-চলা করতে পারে না। এই কাঁপুনির সমাধানে ‘ডিপ ব্রেইন স্টিম্যুলেশন’ চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন টিপু আজিজ।
এ পদ্ধতি নিয়ে টিপু আজিজ বলেন, ‘মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট কিছু কোষের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে এমন হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগীর মস্তিষ্কের প্রায় ৮ সেন্টিমিটার গভীরে ওই নির্দিষ্ট কোষে একটি বৈদ্যুতিক তার স্থাপন করে দেওয়া হয়। রোগীর বুকের চামড়ার নিচে বসানো পেসমেকারের (এক প্রকার ব্যাটারি, যা হৃদ্রোগেও ব্যবহৃত হয়) সঙ্গে ওই তারের সংযোগ থাকে। মস্তিষ্কে স্থাপিত ধাতব তার কোষগুলোতে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ পালস বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়। এতে ওই কোষের স্নায়ু অবশ হয়ে যায়।
পারকিনসন চিকিৎসায় টিপু আজিজের সফল অস্ত্রোপচার নিয়ে ২০১৮ সালে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, পেসমেকার চালু বা বন্ধ করার জন্য রোগীর হাতে একটি বিশেষ রিমোট কন্ট্রোলার আছে। পেসমেকার বন্ধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে রোগীর হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। আর চালু করামাত্রই কাঁপুনি বন্ধ হয়ে যায়। পারকিনসন চিকিৎসায় এটিকে ‘অলৌকিক’ পদ্ধতি আখ্যায়িত করা হয়।
অধ্যাপক আজিজ বলেন, এই চিকিৎসা পারকিনসন রোগ ভালো করে না। কিন্তু রোগের উপসর্গগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সাহায্য করে। বিশ্বে পারকিনসন রোগের এটাই সেরা চিকিৎসা বলে জানান তিনি। এ পর্যন্ত তিনি দুই হাজারের বেশি রোগীকে অস্ত্রোপচার করেছেন। বিশ্বে প্রায় আড়াই লাখ রোগী এই চিকিৎসার ফলে উপকৃত হয়েছে।
খাবারে অনীহাও দূর হতে পারে
একই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের অন্য কিছু কোষের আচরণ বদলে দিয়ে অ্যানোরেক্সিয়া (খাদ্যে অনীহা) রোগের চিকিৎসায় সুফল পাওয়া গেছে বলে জানালেন টিপু আজিজ। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের শারীরিক ব্যথা কমাতে ব্রেইন স্টিমিউলেশন পদ্ধতি ভালো সুফল দেবে। এসব বিষয় এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। টিপু আজিজ বলেন, ‘মস্তিষ্কের কোষগুলোর আচরণ সম্পর্কে যত জানব, তত বেশি রোগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।’
ব্রেইন স্টিমুলেশনের পথিকৃৎ
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব সার্জিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক টিপু আজিজ। তাঁর অধীনে বর্তমানে তিনজন শিক্ষার্থী পিএইচডি করছেন। তাঁদের মধ্যে অ্যালেক্স গ্রিন নামের এক ছাত্র উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্রেইন স্টিমুলেশন পদ্ধতি প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করছেন। এর আগে ২০ জন শিক্ষার্থী তাঁর অধীনে পিএইচডি সম্পন্ন করে বিভিন্ন দেশে ব্রেইন স্টিমুলেশন নিয়ে কাজ করছেন। এ ছাড়া তিনি ডিপ ব্রেইন সার্জারির প্রশিক্ষণ দেন। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ডিপ ব্রেইন স্টিম্যুলেশন সেন্টার চালুতে সহায়তা করেছেন তিনি। যুক্তরাজ্যের ১৩টি হাসপাতালে পারকিনসন চিকিৎসার ওই সেবা চালু হয়েছে।
যেভাবে শুরু
টিপু আজিজ যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে স্নাতক করেছেন। কিংস কলেজ থেকে এমবিবিএস করেছেন। এরপর ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে নিউরোফিজিওলজি বিষয়ে পিএইচডি করেন। পিএইচডি গবেষণায় তিনি বানরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেন, ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশনের মাধ্যমে পারকিনসন রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ১৯৯২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অব সার্জিক্যাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিভাগীয় প্রধান ক্রিস অ্যাডাম তখন তাঁকে পারকিনসন রোগীর ওপর গবেষণার পরামর্শ দেন।
টিপু আজিজ বলেন, ‘আমি সব সময় বিশ্বাস করতাম, মানুষের রোগ বোঝার আগে বানরের ওপর গবেষণা দরকার।’ তাঁর গবেষণায় তিনি প্রায় ৩০টি বানর ব্যবহার করেছেন। এ কারণে তাঁকে প্রাণী অধিকার আন্দোলনকর্মীদের কাছ থেকে নানা হুমকি পেতে হয়েছে। পাঁচ–ছয় বছর তিনি পুলিশি সুরক্ষায় ছিলেন। তবে অক্সফোর্ড এ গবেষণা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছে।
সব কৃতিত্ব মায়ের
নিজের অর্জনের সব কৃতিত্বই মাকে দিতে চান টিপু আজিজ। তিনি বলেন, ‘মা সাহস করে আমাদের চার ভাইবোনকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসেন। নিজে কষ্ট করে আমাদের সব সুযোগ দিয়েছেন। সকল কৃতজ্ঞতা আমার মায়ের কাছেই।’
ভাবনায় বাংলাদেশ
মা যখন ছিলেন, তখন প্রায়ই বাংলাদেশে যেতেন। এখন এক বোন ঢাকায় থাকেন। তাই বছরে দু-তিনবার যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশে পারকিনসন রোগী অনেক। তাই সেখানে ‘ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন সার্জারি’ চালু জরুরি বলে মনে করেন টিপু আজিজ। কারণ, বিদেশে গিয়ে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার সামর্থ্য খুব কম লোকের আছে। অনেক বছর ধরে চেষ্টা করেও তিনি বাংলাদেশে এই সেবা চালু করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে অবকাঠামো এবং তহবিলের জোগান বড় সমস্যা। জানালেন, যুক্তরাজ্যে ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন সার্জারির জন্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আরও অনেক কম অর্থে সেটি করা সম্ভব হবে। আবার মস্তিষ্কে ধাতব তার স্থাপনের বদলে দায়ী কোষগুলোকে নিস্তেজ করে দিলে খরচ অর্ধেকে নেমে আসে। কিন্তু এই অস্ত্রোপচারে ঝুঁকি বেশি, তাই বেশ দক্ষ হাতে এটি করতে হয়।