স্কটল্যান্ডের তিন শহরে

স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। স্কটল্যান্ডের আভিজাত্য বুঝতে হলে এখানে আসতেই হবে। ছবি: লেখক
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। স্কটল্যান্ডের আভিজাত্য বুঝতে হলে এখানে আসতেই হবে। ছবি: লেখক

লন্ডনে যাওয়ার পর আমরা এক আড্ডায় বসেছিলাম। আড্ডার চারজন স্কটল্যান্ডের গল্প জুড়ে দিলেন। এই শহরে সেই শহরের গল্প শুনতে শুনতে আমরাও সেখানে যাওয়ার কথা ভাবলাম। লন্ডনে ঘুরতে ঘরতে পরিকল্পনা হলো, স্কটল্যান্ডে যাওয়া যায় চার-পাঁচ দিনের জন্য। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে দিন ঠিক করে লন্ডন থেকে রাতের বাসে করে শুরু হলো যাত্রা। সঙ্গী স্ত্রী আইরিন আসাদ। আমাদের গন্তব্য এডিনবরা, ইনভারনেস ও ডান্ডি। 

স্কটল্যান্ডে গেলে সবচেয়ে বেশি পর্যটক দেখেন শহররে এক প্রান্ত থাকা হলিরুড প্যালেস। হলিরুড প্যালেস হচ্ছে স্কটল্যান্ডে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সরকারি বাসভবন।

প্রথমে আমাদের গন্তব্য স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা বা এডিনবার্গ। স্কটল্যান্ডের আভিজাত্য বুঝতে হলে এখানে আসতেই হবে। উঁচু উঁচু প্রাচীন ভবনে ভরা এই শহর। শহরের মধ্যেই চলছে ট্রাম। স্কটল্যান্ডের রাজধানী ১ হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো এবং সংস্কৃতি ও ইতিহাসে পরিপূর্ণ দুর্গ, পুরোনো শহরের কেন্দ্র এবং অনেক জাদুঘর এডিনবরাকে পর্যটকদের কাছে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানের মর্যাদা দিয়েছে৷

এডিনবরা ওল্ড টাউন।

শহরের ভেতরে আছে প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেনস। সেখানেই রয়েছে স্কটিশ ঔপন্যাসিক, ‘আইভ্যান হো’র লেখক ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিতে বানানো এই বিশাল সৌধ। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্মৃতিসৌধ। সোনালি রোদ যখন আলো ছড়াচ্ছে, তখন মানুষ এসে ভিড় করছে এই বাগানে। রোদ পোহাতে পোহাতে চলছে তুমুল আড্ডা। 

শহরে থাকা এডিনবরা ক্যাসেল বেশ সমৃদ্ধ।

এই শহর দুই ভাগে বিভক্ত। মধ্যযুগে বানানো ‘ওল্ড টাউন’ বা পুরোনো শহর এবং ১৮-১৯ শতকে গড়ে ওঠা ‘নিউ টাউন’ বা নতুন শহর। এখানে ভ্রমণের মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংগ্রহশালা। 

নেস নদীর এই সেতু ইনভারনেসের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

শহরে থাকা এডিনবরা ক্যাসেল বেশ সমৃদ্ধ। স্কটল্যান্ডে গেলে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এই দুর্গে দেখেন শহরের এক প্রান্তে থাকা হলিরুড প্যালেস। হলিরুড প্যালেস হচ্ছে স্কটল্যান্ডে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সরকারি বাসভবন। ভেতরে ঢুকে এর স্থাপত্যশৈলী আর ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই! 

বেরিয়ে এসেই স্কটল্যান্ড পার্লামেন্ট। পুলিশের সশস্ত্র পাহারা দেখে ভাবলাম, পাস ছাড়া যাওয়া যাবে না। কিন্তু অবাক করে দিয়ে পুলিশ ভেতরে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানালেন। 

ইনভারনেস ক্যাসেল

এডিনবরা ক্যাসেল ও হলিরুড প্রাসাদের মাঝখানের রাস্তাটি ‘রয়্যাল মাইল’ নামে পরিচিত। খোয়া বিছানো এই পথটি দুই কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি গিয়ে শেষ হয়েছে এডিনবরার সবচেয়ে পুরোনো গির্জা সেন্ট গিলস ক্যাথেড্রালে। 

এখানে পাথরের ইট বাঁধানো রাস্তার দুপাশে রয়েছে খাবারের দোকানসহ নানা পণ্যের দোকান। শিল্পের ছোঁয়া পাওয়া যাবে ন্যাশনাল গ্যালারিতে। লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মোনে, দেগা—বহু খ্যাতনামা শিল্পীর কীর্তি সযত্নে রক্ষিত এখানে।

এখানকার বাড়িগুলো একেকটা রাজপ্রাসাদ।

এডিনবরায় দেখার মতো আছে স্কট মনুমেন্ট। এখানের বিভিন্ন স্থান এমনভাবে তৈরি করা আছে, যেখানে বিভিন্ন উচ্চতা থেকে পুরো এডিনবরা শহর দেখা যায়।

শহরের দোকানে দোকানে আছে স্মারক উপহার। পাথরের ওপর শহরের ছবি তাতে লেখা শহরের নাম। এটি আমাকে আকর্ষণ করল। স্কটল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি এখানে বেশি বিক্রি হয়। স্কটিশ ঐতিহ্যবাহী ভেড়ার লোমের তৈরি মাফলার এখানে বিখ্যাত। এটিও পাওয়া গেল সাধ্যের মধ্যে। 

রাতের এডিনবরা যেন আরেক রূপ ধারণ করে। আলোর ঝলকানি আর খেলা দেখে অবাক হই। একই জায়গা দিনে এক রকম, আর রাতে আরেক! 

ইনভারনেসে নেস নদীর সেতুর ওপর তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে কোনো প্রেমিক

পরদিন আমাদের গন্তব্য ইনভারনেস। স্কটল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চলের রাজধানী। পাহাড় ও সমুদ্রের পটভূমিতে ইনভারনেস অতুলনীয়। এটি স্কটল্যান্ড তথা যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ শহর। বাসে যাওয়ার পথে পড়েছে স্কটল্যান্ডের গ্রাম। মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। রাস্তার পাশে নদীর ওপর পাহাড়ের দেখা পাওয়া গেল। শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা যেন এক ছবি। শরতের শেষে গাছের পাতা হলদেটে হওয়া শুরু হয়েছে। সে এক অপার সৌন্দর্য। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের ওপর মস্ত খোলা আকাশ। মাঠের পর মাঠ ভেড়ার পাল। রাখাল ছাড়াই একা একা চড়ে বেড়াচ্ছে ওরা। বাসের যাত্রী এক পর্যটক বললেন, এখানকার কিছু গ্রামে নাকি মানুষের চেয়ে ভেড়ার সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। 

ইনভারনেসে নেমে দেখলাম টিপ টিপ বৃষ্টি। সকালে একটা খাবারের দোকানে বসে খাবার খেতে খেতেই রোদ উঠে গেল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঝটপট। কিছুটা উঁচু জায়গায় ইনভারনেস ক্যাসেলে উঠলাম। ওপর থেকে শহর দেখা যায়। নিচে নেমে নেস নদীর পাশে দেখলাম নেস ব্রিজ। নদীর মাঝখানে এই ব্রিজ নদীদিকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছে। ব্রিজের এখানে–সেখানে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে অনেক পর্যটক তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। শহর থেকে একটু দূরেই ইডেন কোর্ট নামের থিয়েটার। থিয়েটারটির নির্মাণশৈলীও চমৎকার। থিয়েটারের পাশের গির্জাটি অনেক সমৃদ্ধ। নদীর তীর ঘেঁষে যেসব বাড়ি গড়ে উঠেছে, প্রতিটি বাড়ি তৈরি হয়েছে একই নকশায়। সব বাড়ির সামনে-পেছনে বাগান। দেবদারু, ওক, পাইনগাছ। দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া ক্যাসেলে। নদীর তীরে রাস্তার ওপর আর্ট গ্যালারি। হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী সেখানে। 

এবার আমাদের গন্তব্য ডান্ডি। এ যে আসলেই ডান্ডি! ১০ ঘণ্টার ভ্রমণের পর সকালের আলো ফুটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ডান্ডি শহরে। হাই স্ট্রিটের একটি হোটেল ঠিক করা ছিল আগে থেকেই। হোটেল ঠিক শহরের মাঝখানে। রোদেলা দিন। এ ধরনের দিনের জন্য নাকি এখানকার মানুষ অপেক্ষা করেন। হোটেলেই পাওয়া গেল ভ্রমণের মানচিত্র। একে একে দেখার জন্য বের হলাম আমরা। বাঁশির শব্দ শুনে ঘুরে তাকালাম। দুই শিশুর একজন স্কটল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে ঢোলে তাল দিচ্ছে আরেক শিশু। একটু দূরেই অ্যাকর্ডিয়ন নামের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন মধ্যবয়সী ব্যক্তি। মুগ্ধ হয়ে গেলাম সেই সব সুর শুনে। 

ডান্ডিতে অভিজাত ভবন

হোটেলের সবচেয়ে কাছে ছিল ডান্ডি মিউজিয়াম। এর ভেতরে প্রবেশের পর দেখলাম, এখানে রয়েছে দুর্লভ কিছু চিত্রশিল্প। কিছু বন্য প্রাণীর দেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায়। ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাচের আলমারিতে।

স্কটল্যান্ডের এই শহরের বিশেষত্ব হলো অভিজাত সব বহুতল ভবন। শহরের মাঝখানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাস্কর্য। শহরের পাশে দুই শ বছর আগের ২১৩ ফুট লম্বা সেন্ট পলস গির্জা। ভেতরে ঢুকতেই স্থানীয় এক নারী স্বাগত জানালেন। বাংলাদেশ থেকে আসার কথা শুনে আমের প্রসঙ্গ তুললেন। তাঁর এক বন্ধু একবার আম খাইয়েছিলেন, সেই স্বাদ নাকি তিনি ভুলতে পারেন না। 

গির্জার পাশে দুই শ বছরের পুরোনো সিমেট্রি। ভেতরে এসে স্বজনেরা ফুল দিয়ে যাচ্ছে। শহরটা খুব গোছালো। ব্রিটিশ কমিক ম্যাগাজিনের চরিত্র ডেসপারেট ড্যানের ভাস্কর্য থেকে তাকালে বড় বড় দোকানপাট চোখে পড়ে, আর এর পাশেই বিচারালয় ডান্ডি শ্যারিফ কোর্ট। স্কটল্যান্ডের একমাত্র পাটের জাদুঘরটিও এখানে অবস্থিত। বিকেলে ঘুরতে এলাম ড্যান্ডির টেই রেল ব্রিজ দেখতে। নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দেখতে দেখতে ঝুপ করে রাত নেমে এল। রাতের ডান্ডি দেখার জন্য বাসের টিকিট কাটা হলো। ঘুরে ঘুরে পুরো শহর দেখতে বের হলাম আমরা। রাত ১০টা নাগাদ হোটেলে আসতে আসতে লক্ষ করলাম শহরে সুনসান নীরবতা। কেবল পানশালায় মানুষের আড্ডা। গির্জা থেকে ঘণ্টার ধ্বনি নীরবতা ভেঙে দিয়ে গেল। 

ডান্ডি শহরে ব্রিটিশ কমিক ম্যাগাজিনের চরিত্র ডেসপারেট ড্যানের ভাস্কর্য

যেভাবে যাবেন
যুক্তরাজ্যের ভিসা নিয়ে আপনি স্কটল্যান্ডে ঘুরতে যেতে পারেন। লন্ডন থেকে বাসে বা ট্রেনে স্কটল্যান্ড। সেখানে বাসে করে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়া যায়। স্থানীয় শহরগুলোতে বাসে ডে সেভার নামে টিকিট কাটলে আপনি যতবার খুশি উঠতে পারবেন।