বাজারে এক সারিতে কয়েকটি সেলুন। তেমন কোনো জৌলুশ নেই। টিনের ঘরের ওই সেলুনে আছে দুটি চেয়ার, একটি বড় ঝোলানো আয়না আর সামনে যন্ত্রপাতি রাখার কাঠের তাক। এর মধ্যে কিছুটা ভিন্ন চিত্র মিলন সেলুনে। ওই সেলুনের এক কোণে রাখা আছে একটি আলমারি। তাতে সাজানো থরে থরে বই। সেলুনটির মালিক মিলন শীল।
আলমারিতে শোভা পাচ্ছে প্রায় ৩০০ বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে নানা লেখক জায়গা পেয়েছেন সেখানে। কিছু বই মিলন নিজ উদ্যোগে কিনেছেন। কিছু বই বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেলুনে চুল কাটাতে আসা বা অন্য কোনো কাজে আসা কেউ কেউ বসে এসব বই পড়েন। আবার চাইলে খাতায় নাম, ঠিকানা লিখে বই বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া যায়।
মিলন শীলের বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার হেতালবুনিয়া গ্রামে। তাঁর সেলুনটি বটিয়াঘাটা বাজারে। ১৯ বছর আগে সেলুনটি দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। ১৩ বছর আগে বাবার হাত ধরে ওই সেলুনের দায়িত্ব নেন মিলন।
প্রথম ধাপে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। আর্থিক সংকট তাড়াতে কাজে ঢুকে পড়তে হয় মিলনকে। সেলুনে প্রতিদিন রাখা হতো সংবাদপত্র। অবসরে ওই সংবাদপত্র পড়তেন তিনি। ধীরে ধীরে পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। ওই সময় এক বন্ধুর কাছ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মেজদিদি বইটি পড়ার জন্য নেন। ভালো লেগে যায়। বই পড়ার প্রতি উৎসাহ বাড়ে মিলনের। এরপর নিজে বই কেনেন এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা শুরু করেন। আগ্রহ দেখে বন্ধুবান্ধবও তাঁকে বই উপহার দিতে থাকেন। এভাবেই বইগুলো ঠাঁই নেয় মিলনের সেলুনে।
সেলুন চালানো আর বই পড়ার ফাঁকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসও করেছেন মিলন। বর্তমানে পুরোদস্তুর সেলুনের কাজে মনোযোগী তিনি। আর সময় পেলেই বইয়ে চোখ বোলান।
মিলন শীল বলেন, ‘প্রথমে বাড়িতেই রেখেছিলাম বইগুলো। কিন্তু কেউ নিলে আর ফেরত দিত না। পরে বইগুলো সেলুনে নিয়ে আসি। এখন এটাই বড় লাইব্রেরি।
উপজেলায় কোনো পাবলিক লাইব্রেরি নেই। এ কারণে বই পড়তে আগ্রহী ব্যক্তিরা এসে বসেন মিলনের সেলুনে। ঠিক দুপুরের দিকে সেলুনে বই পড়ছিলেন বটিয়াঘাটা কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী হরপ্রসাদ সানা। তিনি বলেন, ‘গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে। তাই মাঝেমধ্যে এসে এখানে পড়ি। অনেক সময় বাসায়ও নিয়ে যাই।’
পুরোনো লেখকের বই পড়তে বেশি পছন্দ করেন মিলন। এ কারণে তাঁর সংগ্রহে বেশির ভাগই আগের দিনের খ্যাতিমান লেখকদের বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চয়িতা, কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা, শরৎচন্দ্রের মেজদিদি, শ্রীকান্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের শাপমোচন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বেশি দূরে নয়, মধুসূদন রচনাসমগ্রসহ অনেক বই আছে তাঁর দোকানে।
সেলুনের ভেতরে এমন ছোট লাইব্রেরি গড়ে তোলায় ২০১৬ সালে ঘুমভাঙ্গানিয়া নামের স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলন শীলকে শুভেচ্ছা স্মারক উপহার দেয়। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সজীব দত্ত বলেন, ‘মিলন শীল আমাদের সমাজের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজের সাধ্যের মধ্যে তিনি একটি মহৎ কাজ করছেন। তাঁর মহত্ত্বকে আমরা সম্মান করি।’