সুন্দরবনে ৯০ দিন

একদিন গহিন সুন্দরবনে। ছবি: লেখক
একদিন গহিন সুন্দরবনে। ছবি: লেখক


ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ থেকে মে মাসের ১২—এই তিন মাস সুন্দরবনে বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করল বন বিভাগ। এ কাজে তাদের সহায়তা করেছে ওয়াইল্ড টিম নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটির ২৫ জন সদস্য চষে বেড়িয়েছেন সুন্দরবনের খুলনা ও শরণখোলা রেঞ্জ। বাঘের পেছনে ছুটতে ছুটতে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এই দলের তরুণ সদস্য  আবু সাঈদ। তাঁর কাছেই শুনুন সুন্দরবনের গা-ছমছমে অভিযানের গল্প।

সেদিন নদী থেকে উদ্ধার হওয়ার পর

শুরুতেই বাঁচা-মরা

সুন্দরবনে কাজ শুরুর কয়েক দিনের মাথায় রীতিমতো নতুন জীবন পেয়েছিলাম! ২৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। বনে কাজ করে ইঞ্জিনচালিত সাম্পানে ফিরেছি। সাম্পানটা ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। বনে কাজ করতে গেলে প্রায়ই আমাদের সারা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে যেত। ফলে বন থেকে ফিরে সাম্পানে উঠেই আমাদের প্রথম কাজ ছিল পুরো শরীর পরিষ্কার করা। সেদিনও বালতির পানি ঢালছি শরীরে। কাদামাখা পা পরিষ্কার করছিলেন দলের সদস্য বিপ্লব কান্তি সরকার। হঠাৎ দেখলেন, তাঁর পায়ে একটা জোঁক সেঁটে আছে ট্যাটুর মতো। অনবরত রক্ত ঝরছে পা থেকে। সেটা দেখে আমাদের ‘হংসরাজ’ দলের নেতা তানভীর খান সবাইকে বললেন, ‘সবার পা চেক করো, জোঁক থাকতে পারে।’

তুমুল বেগে ছুটতে থাকা সাম্পানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমিও কাদামাখা পা দুটি দেখছি, জোঁক আবার সঙ্গী হলো কি না। হঠাৎ একটা ঢেউয়ের ঝাপটা; মুহূর্তেই ঝপাৎ করে নদীতে পরে গেলাম আমি! খানিক পর পানির ওপরে মুখ তুলে দেখি, সাম্পানটা বেশ অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে। আমার বুকে যেন আর বাতাস নেই! বলেশ্বর নদ তখন উত্তাল। বড় বড় ঢেউয়ে আমি যেন খড়কুটো। এই তলিয়ে যাচ্ছি, এই ভাসছি। আমার পায়ে জঙ্গল বুট, সাঁতারও কাটতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি শেষ!

হঠাৎ আবছা চোখে খেয়াল করলাম, তানভীর ভাই নদীতে ঝাঁপ দিলেন। এর আগে কাউকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে দেখে এতটা ভালো লাগেনি। বুকের ধুকপুকানি খানিকটা কমে এল। সেদিন ঠিক সময়ে আমাকে উদ্ধার না করলে আজ এই লেখাটা লিখতে পারতাম কি না কে জানে!

যাত্রা হলো শুরু

বাঘ কিংবা আমাদের মধ্যাহ্নভোজ

সুন্দরবনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছিলাম ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে। শুরুতে মনে একটা অজানা ভয়, কীভাবে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। ১২ তারিখ ‘মাহিরা’ নামের লঞ্চটা খুলনার জেলখানা ঘাট থেকে সুন্দরবনের দিকে যাত্রা করল। ১৩ ও ১৪ তারিখ দুই দিন সুন্দরবনে আমরা কীভাবে কাজ করব, সেসব নিয়ে প্রশিক্ষণ নিলাম। আমরা বলতে মোট ২৫ জনের দল। পাঁচজনের ছোট ছোট পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করেছি আমরা। আমি ছিলাম একটা দলের গবেষণা সহকারী। কাজ ছিল দলের সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরে ঘুরে বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা আর সংগৃহীত ছবি ও তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করা।

সুন্দরবনের গহিনে কাজ করলেও রাতে আমাদের থাকা-খাওয়ার জায়গা ছিল ওই ‘মাহিরা’ আর ‘অবসরেই’। নদীতে লঞ্চ রেখে আমরা বনে চলে যেতাম ইঞ্জিনচালিত সাম্পান নিয়ে। সকাল আটটায় বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতে ফিরতে কোনো দিন বিকেল, সন্ধ্যা কিংবা রাত। এই সময়টায় দুপুরের খাওয়া সারতে হতো বনের ভেতরে। দুপুরে খেতে খেতে মনে হতো, নিজেই না কবে বাঘ মামার দুপুরের খাবার হয়ে যাই!

ডুবে ডুবে হরিণ দেখা

ছদ্মবেশে বুনো জীবন

বন বিভাগের ক্যাম্পের পাশে ঠিক সন্ধ্যার পর আমরা টর্চলাইট নিয়ে বসে থাকতাম। কান পেতে থাকতাম মৃদু ঝমঝম শব্দের জন্য। অপেক্ষার প্রহর গুনতাম, কখন বেরোবে। দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর হঠাৎ কানে আসত সেই শব্দ। কান খাড়া করে টর্চের আলো ফেললেই দেখা মিলত এক বা একাধিক শজারুর। কাঁটাওয়ালা শজারু দেখে রোমাঞ্চে আমাদের গায়েও কাঁটা দিত! টর্চের আলোয় অনিন্দ্যসুন্দর দেখায় এই প্রাণীটা। বিশেষ করে চোখ ঝলসানো আলোয় কাঁটাওয়ালা শজারুগুলোকে লাগে ঠিক রেড ইন্ডিয়ান যোদ্ধাদের মতো!

কেবল শজারু নয়, হরিণ, শূকর আর পাখি দেখার জন্যও অনেক কায়দা-কসরত করতে হতো আমাদের। কখনো শাপলার পাতা মাথায় দিয়ে শরীরটা মুখ পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতাম বন বিভাগের ক্যাম্পের পুকুরে। আবার কখনো সারা শরীর গাছের লতাপাতায় মুড়িয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম চার-পাঁচ হাত সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া একদল হরিণ দেখার জন্য।

বাঘ গেছে যে পথে

বাঘ যখন আমাদের পেছনে

১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। একটা জায়গায় পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। ঝটপট খানিক দূরেই ক্যামেরা বসালাম আমরা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কাজ শেষ। পায়ের ছাপের পাশ দিয়েই আমাদের ফিরে যেতে হবে। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আগের ছাপের পাশেই নতুন আরেক সারি ছাপ! কিছুক্ষণ আগেই এদিক দিয়ে বাঘ মামা হেঁটে গেছেন। টাটকা ছাপ বলতে যা বোঝায় আরকি।

আমাদের বুক শুকিয়ে কাঠ। কারও মুখে রা নেই। পেছনে নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে বাঘটা। আমরা কিসের বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করব, উল্টো সে-ই হয়তো আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমরা যেন মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ডের অধিবাসী আর বাঘটা হলো ক্যাপ্টেন নিমো! বাঘের আতঙ্কে আমাদের প্রত্যেকের হৃৎপিণ্ড যেন সাময়িক বিরতি নিয়েছে। ভাগ্য ভালো নদীর তীর বেশি দূরে ছিল না। ভিএইচএফ রেডিও দিয়ে আমাদের সাম্পানওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে। সাম্পানটা তীরে ভেড়ার পর মনে হলো হাঁটুতে আর বল পাচ্ছি না! হৃৎপিণ্ডটা ততক্ষণে প্রবল বেগে লাফাতে শুরু করেছে।

দল বেঁধে রেডিও শোনা

ভরসা যখন বাংলাদেশ বেতার

সুন্দরবনের গহিনে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। ফলে প্রায়ই আমরা আক্ষরিক অর্থে নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতাম। এ কারণে দেশের কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা-ও জানার উপায় ছিল না। তেমন যোগাযোগও হতো না পরিবারের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গেই কথা বলেছিলাম প্রায় মাসখানেক পর। সে সময় খবর শোনার একমাত্র ভরসা ছিল বাংলাদেশ বেতার। ভোরে আর দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় লঞ্চের ওপর আমরা একটা রেডিও নিয়ে বসতাম। তথ্যপ্রযুক্তির এই রমরমায় রেডিও শুনতে বসে মনে হতো আমরা বুঝি টাইমমেশিনে চেপে পেছনের কোনো একসময়ে চলে এসেছি! নেটওয়ার্কের বাইরের জীবনটা নেহাত মন্দ নয়। 

গাছের গুঁড়িতেই তার আবাস!

বাদামি গুঁড়িতে সবুজ ভয়ংকর

কাজের জন্য প্রায়ই সরু অনেক খাল পার হতে হয়েছে আমাদের। ভাটায় খালে পানি কম থাকে, তখন হেঁটেই পার হতাম। জোয়ারে পানি বেশি, তাই খাল পার হতে হতো মরা গাছের গুঁড়ি ফেলে। একদিন একটা খাল পার হতে গিয়ে ঘটল অঘটন। মরা একটা গাছের গুঁড়ি তুলতে গেছি সবাই মিলে। একটু ওপরে তোলার পর দলের মনিরুল ভাই ধপাস করে সেটা ফেলে দিলেন। কেন ফেলে দিলেন সে কারণটা তাঁর আর মুখ ফুটে বলতে হলো না। ততক্ষণে গাছের গুঁড়ির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা সবুজ ‘পিট ভাইপার’ সাপটা আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। গাছের গুঁড়িটা ওপরে তোলার সময় মনিরুল ভাইয়ের মুখের ঠিক সামনেই ছিল বিষধর সাপটা! সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়িটা ফেলে না দিলে কী যে হতো!

লাল বাহিনীর আক্রমণ

জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ—সুন্দরবন নিয়ে এই প্রবাদ কে না শুনেছে! তবে ডাঙায় আরেক আতঙ্কের নাম লাল পিঁপড়া। আকারে ছোট হলেও এদের যে হেলাফেলা করতে নেই, তা আমরা টের পেয়েছি হাড়ে হাড়ে, ভুল হলো, আসলে বলা উচিত চামড়ায় চামড়ায়!

সেদিন আমরা সাম্পান থেকে নেমে বনে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছি। পানি থেকে ডাঙায় নামার সময় পানির ওপরে পড়ে থাকা সেতুর মতো একটা গাছ বেছে নিলাম। গাছটা বেয়ে ডাঙায় নামার সময় বাঁধল গন্ডগোল। আত্মরক্ষার জন্য আমরা একটা করে লাঠি রাখতাম সঙ্গে। একজনের হাতে থাকা সেই লাঠি গিয়ে লাগল লাল পিঁপড়ার বাসায়! মুহূর্তে ভেঙে গেল বাসাটা। সঙ্গে সঙ্গে শত শত লাল পিঁপড়া আক্রমণ করে বসল আমাদের শরীরে। এলোপাতাড়ি কামড়ে এমন অবস্থা হলো যে গায়ের জামা খুলে বনের মধ্যে অলিখিত নৃত্য প্রতিযোগিতায় নেমে গেলাম আমরা প্রত্যেকে।

কুমির মশায়ের রোদ পোহানোর সময় তখন!

আবার আসিব ফিরে

সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার কিং কোবরা দেখেছি আমরা। তবে ফণা তোলা কিং কোবরার মুখোমুখি হলাম সুন্দরবনে আমাদের শেষ দিন, অর্থাৎ মে মাসের ১০ তারিখে। আমাদের ‘মোলংগি’ দলের নেতা ইসমে আজম আর আমি সেটার পিছু নিলাম। বেশ কিছুটা পথ পিছু নিয়েও হারিয়ে ফেললাম সাপটাকে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আসলে মনটা খারাপ ছিল ভোর থেকেই। সুন্দরবনে শেষ দিন, কথাটা ভাবতেই বুকের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠছিল প্রতিটাক্ষণ। মনে একরাশ কালো মেঘের আনাগোনা। তার ওপর আকাশটাও কালো হয়ে এল।

ঝড় থামলে উঁকি দিল রংধনু

বেলা ১১টা বাজে তখন, আমরা বনের ভেতরে ঢুকেছি। উত্তর দিক থেকে ভেসে আসা কনকনে বাতাস শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। মে মাসের শুরু থেকেই একাধিক কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তি দেখেছি আমরা। সেদিনও পুরো আকাশ ছেয়ে গেল দৈত্যাকার কালো মেঘে। শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি। চারপাশটা কেমন অচেনা হয়ে গেল নিমেষেই। পথ হারিয়ে ফেললাম আমরা। একটা জায়গাতেই ফিরে আসছিলাম ঘুরেফিরে। কেতাবি ভাষায় যেটাকে বলে ‘ডেথ সার্কেল’। জিপিএসটাও বন্ধ হয়ে গেছে, ব্যাটারি শেষ। বিক্ষিপ্তভাবে অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে বাতাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বন বিভাগের ক্যাম্পে ফিরলাম আমরা। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে চারটা বেজে গেছে!

ঝড়ের মুহূর্তে

বিকেলে যখন স্পিডবোটে আমরা খেতে বসলাম তখন আবার বিদ্যুৎ চমকে বৃষ্টি শুরু হলো। খাবারদাবার নিয়েই দৌড়ে বনের ভেতর ঢুকে গেলাম সবাই। দুপুরের খাবার খেলাম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই। আক্ষরিক অর্থেই বনভোজন যাকে বলে। বৃষ্টি কমার পর রওনা হলাম লঞ্চের উদ্দেশে। ফেরার পথে দেখি, দূরে আকাশের বুকে বিশাল এক রংধনু উঠেছে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম কতক্ষণ। এত সুন্দর রংধনুও হয়! রংধনুটা দেখতে দেখতে মনে হলো, জীবনের এই তিনটি মাস রংধনুর সাত রঙের মতোই রঙিন ছিল।

সুন্দরবন নিয়ে গবেষণা করছেন, বছরের পর বছর কাজ করছেন—এমন কেউ নই আমি। কিন্তু এই তিন মাসে যে অভিজ্ঞতা আমার হলো তা যেন সারা জীবনের পুঁজি হয়ে রইল। বলতে বাধা নেই, এই অভিজ্ঞতার টানেই মনে হয় আবার আসিব ফিরে এই সুন্দরবনে!