‘পড়াশোনা করেছেন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কিন্তু কাজ করছেন বিজ্ঞাপন ও সিনেমা নিয়ে। পথচলার গতি পরিবর্তন হলো কীভাবে?’ এমন প্রশ্নে প্রাণোচ্ছল হাসি। হাসিমাখা কণ্ঠেই বললেন, ‘আসলে পথচলার এই গতি পরিবর্তন কোনো রকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছি। অভিভাবকদের সঙ্গে আমারও চিন্তা ছিল ভালো ফল করব। বিদেশ গিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষে জোশ একটা চাকরি করব। একদম অজান্তেই আজকের আমি। মনের কথা শুনে, আনন্দের সঙ্গে কাজ করে উত্তর মেরুতে যাওয়ার রাস্তা ধরে দক্ষিণ মেরুর সফল একজন।’ নিজের সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ে এমনটাই বলছিলেন রাকা নোশিন নাওয়ার।
রাকা নোশিন বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও চিত্র পরিচালক। তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন নারী। কাজের মাঝেই আনন্দ। কাজের মাঝেই মুক্তি। আলোয় আলোয় সেই মুক্তি ধরা দেয় সফলতায়। নিজের সফলতার ধাপের শুরুর কথা জানতে চাই রাকার কাছে। ‘আমার এই এরিয়াতে কাজের শুরু ২০১১ সাল থেকে। আসলে স্টুডেন্ট ছিলাম, টিউশনির মতো কিছু একটা করব। তখন আমার বন্ধু রাফি আমাকে নিয়ে এল অ্যাপেল বক্স ফিল্মসে। শুরুর দিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কস্টিউম ডিরেক্টর হিসেবে আমি রাফিকে সহায়তা করতাম। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করলেও আমি প্রচুর গান শুনতাম। ভিডিও দেখতাম। এটাই মনে হয় আমার সৃষ্টিশীলতার বীজ। গান শুনতে শুনতে আমি মনে মনে গানের দৃশ্যগুলো কল্পনা করতাম। যেহেতু কাজের জায়গা ছিল আমার আনন্দ ও ভালোবাসার জায়গা, তাই পছন্দের সব ধরনের কাজ আমি টুকটুক করে শিখে নিতাম। এটাই আমার কাজ, এই কাজের বাইরে আমি আর কোনো কিছু করব না—এমন ভাবনার বিপরীতে সব কাজ শেখা এবং তা প্রয়োগ করার দিকে ছিল আমার প্রচণ্ড ঝোঁক। এই আনন্দের সঙ্গে কাজ শেখাটাই আমার পরম বন্ধু হয়েছে।’ সফলতার যাত্রা শুরু আর কাজ শেখার কথা এভাবেই বললেন রাকা।
কাস্টিং ডিরেকশনের পাশাপাশি মুঠোফোনে নিয়মিত ভিডিও বানাতেন রাকা। ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করেন। ঘুরে বেড়ানোর সব ফুটেজ ভিডিও করতেন শখের বশে। এ ছাড়া যখন যেখানে যা ভালো লাগে ভিডিও করতেন। একেবারে শখের বশে। সেই টুকটুক করে বানানো ভিডিওই তাঁকে পরিচালনার পথে হাঁটতে সাহায্য করে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কাস্টিং ডিরেক্টর থেকে কাস্টিং ডিরেক্টর হলেন। চিত্র পরিচালনার শুরু কবে, শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানতে চাই রাকার কাছে।
‘পরিচালনার শুরু ২০১৭ সালে। ২০১৪ সালে নিজে নিজেই একটা গল্প থেকে শুট করে ভিডিও বানালাম। গল্পটা এমন ছিল, একজন লোকের একটি হাত নেই। কিন্তু অন্য যে হাত আছে, তার প্রপার ব্যবহার করে সে তার জীবন অতিবাহিত করছে। গল্পটা একটু মানবিক ছিল। পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে শুট করে আমার অফিসে সহকর্মী, সিনিয়রদের দেখাই, আসলে জিনিসটা হয়েছে কি না। আমার সব সহকর্মী এত প্রশংসা করল। এক সহকর্মী ভিডিওটি দেখে কেঁদে ফেলল। তাদের কাছে পুরো ভিডিও খুব টাচি ছিল। তো মজার বিষয়, সবাই মিলে আমাকে খুশি হয়ে দশ টাকা বিশ টাকা বকশিশ দিল। সেই টাকাগুলো কাজের প্রেরণাস্বরূপ আমি আমার দরজার সামনে স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখলাম। আমার বস দরজার এই টাকা লাগানোর কথা জানতে চাইলে সবাই ভিডিওটির কথা বলে। এরপর তিনিও ভিডিও দেখেন। ভিডিও দেখে কোনো কথা না বলে বলেন, “তুমি আজকে থেকেই ডিরেকশনে কাজ করো”। তো কাস্টিং থেকে আমি চলে এলাম ডিরেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে। চাকরিক্ষেত্রে এটাকে আমি একধরনের প্রমোশনও মনে করি। তো শুরু হলো পরিচালনার পথে হাঁটা।’
নিয়মিত বিজ্ঞাপন, টিভিসির বাইরেও ২০২২ সালের শুরুতে ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প’ ফিকশন বানিয়েছেন রাকা। এটা প্রথম হলেও এ ধরনের ফিকশন তিনি আরও বানাবেন। ভবিষ্যতে নিয়মিত বিজ্ঞাপন ও নাটক নির্মাণের পাশাপাশি সিনেমা পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন। ওয়েব সিরিজ তৈরি স্বপ্ন আছে। আর দেখেন থিয়েটার নিয়ে স্বপ্ন। সম্প্রতি থিয়েটার নিয়ে ভাবনা খেলা করছে মাথায়। এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ জামিলের তত্ত্বাবধানে থিয়েটারের ওপর তিন মাসের একটি ওয়ার্কশপ করছেন। স্বপ্ন দেখেন থিয়েটার পরিচালনা-নির্দেশনার। আকাশসম স্বপ্নের মধ্যে নতুন নতুন স্বপ্নের উঁকিঝুঁকি। সেই স্বপ্নের পথেই এখন শুধু হেঁটে চলা।