শাওনের কেনাকাটা তাঁর স্ত্রী করে থাকেন। গত ঈদে শাওন ভেবেছিলেন নিজের কেনাকাটা নিজেই করবেন। কিন্তু দোকানে গিয়ে তাঁর অবস্থা খারাপ। কোনটি কিনবেন এত রকম পণ্যের ভিড়ে?
এদিকে রুমির (ছদ্মনাম) বেশ কয়েক দিন ধরেই ঘুম হচ্ছে না এক অদ্ভুত কারণে। একই সঙ্গে তাঁর দুটি চাকরি হয়েছে। একটি সরকারি, আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার। নানা যুক্তিতে দুটি চাকরিই তাঁর কাছে লোভনীয়। কোন চাকরিতে যোগ দেবেন, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, দোদুল্যমানতায় দুলতে থাকে তাঁর মন। শাওন আর রুমির মতো সহজে সিদ্ধান্ত না নিতে পারা বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে।
সিদ্ধান্তহীনতা কী?
সিদ্ধান্তহীনতা বলতে আসলে কী বুঝব—
সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লাগা
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টকর মনে হওয়া
সিদ্ধান্ত নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগা
সিদ্ধান্ত গ্রহণ এড়িয়ে চলা
সিদ্ধান্ত নিজে না নিয়ে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া
বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা
সিদ্ধান্ত নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা বা অনুতাপ বোধ করা ইত্যাদি।
সিদ্ধান্তহীনতার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
কোনো কিছুর ব্যাপারে সহজে সিদ্ধান্ত না নিতে পারার মূল কারণ এর অন্তর্নিহিত ‘উদ্বেগ’। এই উদ্বেগের কারণ হতে পারে—
সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা বোধ
অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে মনোভাব বা সবকিছু নিখুঁত করার প্রবণতা
নিজের প্রতি অনাস্থা বা আত্মবিশ্বাসহীনতা
সবকিছু নেতিবাচকভাবে দেখা
হীনম্মন্যতা
কোনো অবস্থাতেই ব্যর্থতা মেনে না নেওয়ার মনোভাব বা ব্যর্থতার ভয়
কেন অনেকে সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না?
যাঁরা সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তাঁদের সমস্যা তৈরি হয় মূলত শৈশবে।
কিছু কারণ:
সন্তানের মতামত প্রাধান্য না দিয়ে ব্যক্তিগত প্রতিটি বিষয়ে মা-বাবা বা অভিভাবক নিজের মতামত চাপিয়ে দেন (যেমন কখন কোন জামাটা পরবে, কী খাবে, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে ইত্যাদি)। এমন হলে শিশুদের নিজেদের প্রতি আস্থা তৈরি হয় না।
সন্তানকে কঠোর শাসনে মানুষ করা, হেয় করে কথা বলা, সমালোচনা করা, সন্তানের মতামত গ্রাহ্য না করা, ভুলত্রুটি সহজভাবে না নেওয়া, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা ইত্যাদি।
অতিরিক্ত প্রশ্রয়মূলক অভিভাবকত্বও (সন্তান যা চায় তাই দেওয়া, ব্যক্তিগত কাজগুলো নিজে করে দেওয়া, যেমন বড় হওয়ার পরও খাইয়ে দেওয়া, জামাকাপড় বা ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া ইত্যাদি) সন্তানের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা কীভাবে তৈরি হবে?
ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা তৈরি হয়ে যায় শৈশব ও কৈশোরে। যেখানে শিশুর সঙ্গে মা-বাবার আচরণ বা অভিভাবকত্বের ধরন অনেকখানি নির্ভরশীল।
অভিভাবকেরা যা করতে পারেন—
একদম ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে বড়দের ইচ্ছা না চাপিয়ে তাকে স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন। যেমন খাবারের মেনুতে কোনো নির্দিষ্ট খাবার না দিয়ে বেশ কয়েকটি খাবারের (আটার রুটি, পাউরুটি, সিরিয়াল বা ডিম পোচ, সেদ্ধ ডিম, ডিম ভাজি) মধ্যে তাকে তার পছন্দের খাবারটি বেছে নিতে দিন।
সন্তানের সিদ্ধান্তে সব সময় ভুলত্রুটি ধরতে বিরত থাকুন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের কিছু কিছু কাজে তার মতামত জানতে চান এবং ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণ করুন।
নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে উৎসাহ দিন।
দোকানে গেলে আপনার পরিবারের মূল্যবোধ অনুযায়ী তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজে বেছে নিতে উৎসাহ দিন।
সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তার প্রশংসা করুন।
সিদ্ধান্তহীনতার সমস্যা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবেন?
• প্রথমে ছোটখাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করেন।
নিজের প্রতিদিনকার কাজগুলোতে (কী করবেন, কখন করবেন) অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজে করার চেষ্টা করুন।
বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশায় কিছু বিষয়ে দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিন। যেমন কোন রেস্তোরাঁয় যাবেন, কী খাবার খাবেন, কখন যাবেন ইত্যাদি।
যত ছোট বিষয়ই হোক না কেন, সিদ্ধান্ত সফল হলে সেটায় আলাদা করে মনোযোগ দিন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে যা বিবেচনা করবেন
সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করুন।
জীবনের কোন বিষয়কে আপনি অগ্রাধিকার দেবেন, সে ব্যাপারে পরিষ্কার থাকুন।
শুধু নির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্তের কথা না ভেবে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের কথা মাথায় রাখুন। এর মধ্যে সবকিছুর বিবেচনায় যা সবচেয়ে ভালো মনে হবে, সেটি গ্রহণ করুন।
দু-তিনটি সুযোগের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলো, আপনার মন যেদিকে টানে সেটি বিবেচনা করুন।
জীবনের বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে
আবেগের বশবর্তী হয়ে (যেমন রেগে গিয়ে, কষ্ট পেয়ে, অতিরিক্ত খুশি অবস্থায়) কখনো হঠাৎ জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নেবেন না। যেমন ডিভোর্স দেওয়া, বিয়ের সিদ্ধান্ত, বিদেশে যাওয়া ইত্যাদি)। অতিরিক্ত আবেগে আক্রান্ত অবস্থায় আমাদের চিন্তা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়, ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আবেগ প্রশমিত হওয়ার জন্য সময় নিন।
যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জীবনের পথপরিক্রমা নির্ধারণ করে। কখনো মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাই এসব বিষয়ে প্রয়োজনে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব বা গুরুজনের পরামর্শ বিবেচনার মধ্যে আনুন।
বড় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্বস্তিবোধ করলে, সেই ‘অস্বস্তি’ বা ‘গাট ফিলিং’কে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। অনেক কিছুই আছে, যা আমরা সচেতনভাবে দেখতে চাই না, কিন্তু আমাদের অবচেতন মন নানাভাবে সেটা জানান দেয়।
ছোটখাটো সিদ্ধান্তের বেলায়
প্রতিদিনকার ছোটখাটো বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ করবেন না। এসব বিষয়ে ছোটখাটো ভুল আপনার জীবনধারার গতিপথে খুব বেশি পরিবর্তন আনবে না। বরং এসব নিয়ে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ আপনার অযথা সময়ক্ষেপণ করবে।
পেশাগত জীবনের সিদ্ধান্ত
পেশা নির্বাচন, পরিবর্তন, বদলি, চাকরি ছেড়ে দেওয়া, ঊর্ধ্বতন/অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেই নানা সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
পেশা নির্বাচন বা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আপনার ভালো লাগা বা মনের টানকে এবং দক্ষতার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া ভালো। কারণ, পেশাগত জীবন আমাদের অনেকটা জুড়ে থাকে। পেশার প্রতি ভালোবাসা আপনার দক্ষতার উৎকর্ষ ঘটাতে সাহায্য করবে।
যথেষ্ট কারণ থাকলেও বদলি বা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কখনো হুট করে বা রাগ করে নেবেন না। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পরামর্শ বা সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় আনবেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কয়েক দফায় এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে নিন।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে (যেমন ব্যবসায় অনেক টাকা খাটানো, বাড়ি কেনা) নামার আগে প্রত্যাশিত ফলাফলের বাইরে নেতিবাচক ফলাফল ভেবে দেখুন। নেতিবাচক ফলাফল আপনাকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বা আপনি কতটুকু সামাল দিতে পারবেন বা গ্রহণ করতে পারবেন—সবদিক ভালোভাবে বিশ্লেষণ করুন।
পরিবার ও বিশ্বস্ত বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করুন। ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে কাছের মানুষের সাপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্তের আগে বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে নেওয়া ভালো।
প্রতিনিয়ত না চাইলেও ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পেশাগত বা সামাজিক জীবনে আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সময়মতো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর অনেক ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে। শুধু তা-ই না, প্রতি মুহূর্তের ভালো-খারাপ থাকার নির্ণায়কও ছোট ছোট নানা সিদ্ধান্ত।
মেখলা সরকার: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।