১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ (সিডও) সনদ গ্রহণ করে। এর পাঁচ বছর পর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার সনদটি অনুমোদন করে। অনুমোদনের সময় সরকার চারটি ধারায় আপত্তিসহ স্বাক্ষর করে। পরে ১৯৯৭ সালে দুটি ধারা থেকে বাংলাদেশ তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়। বাকি দুটি ধারা থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু অনুমোদনের এত বছর পরও বাকি ধারাগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ব্যাপারে প্রথম আলো কথা বলেছে সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খানের সঙ্গে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোকেয়া রহমান
প্রথম আলো: সিডও সনদ গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠায় এবং বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কতখানি সাফল্য পেয়েছে?
সালমা খান: বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে সিডও সনদ পরিগ্রহণ করে। ৩৩ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে লিঙ্গসমতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা যেমন বলা যাবে না, তেমনি নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ বিরাট সাফল্য পেয়েছে তাও বলা যাবে না। লিঙ্গসমতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হলে আর নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্য পেলে তো কোনো কথা ছিল না। এ জন্য সিডও সনদের পুরোপুরি বাস্তবায়ন চাই। কোনো সনদ পরিগ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে সনদটি রাষ্ট্রের পক্ষে একটি দায়বদ্ধ মুচলেকাস্বরূপ। সিডও সনদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে প্রথম দেখতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি আইনি বৈষম্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথাগত বৈষম্য বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সব বৈষম্যমূলক আইন পরিহার করতে হবে এবং শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ৈবষম্য দূর করতে হবে।
প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা অবসানে সবচেয়ে বড় বাধাগুলো কী?
সালমা খান: নারীর প্রতি সহিংসতা অবসানে সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের দেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজে নারীকে এখনো ছোট চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশে আড়াই দশক ধরে নারী ক্ষমতায়। এতে করে অনেকের মনে হতে পারে এ দেশে নারীর ব্যাপক ক্ষমতায়ন হয়েছে। কিন্তু আসলে তা হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। স্থানীয় কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীর ওপর সহিংসতা আরও বাড়ছে। আমরাও এটা বুঝতে পারি। বিশেষ করে কিশোরীদের রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে, মুঠোফোনে আপত্তিকর ছবি তুলে তা প্রচার করা হচ্ছে। বছর দু-এক আগে আইসিডিডিআরবি পুরুষদের ওপর একটি জরিপ চালায়। তাতে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনি কি নারীকে অধস্তন মনে করেন? ৯৭ শতাংশ পুরুষের উত্তর ছিল হ্যাঁ। জরিপের এই ফল দেখেই বোঝা যায়, আমাদের সমাজে নারীকে কী চোখে দেখা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে বর্তমানে ইতিবাচক অগ্রগতি কী কী হচ্ছে?
সালমা খান: নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে যেসব ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, তার মধ্যে অনেক আইন হয়েছে। নারী সুরক্ষায় ১৫টির বেশি আইন হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসব আইনের বাস্তবায়ন নেই। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে অনেক বেসরকারি সংস্থা ও নারী সংগঠন আন্দোলন করছে। এটাকে ইতিবাচক অগ্রগতি বলা যেতে পারে।
প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে তরুণেরা কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেন?
সালমা খান: আমাদের জনসংখ্যার সিংহভাগই তরুণ। তাদের চিন্তা, চেতনা, মূল্যবোধে দেশপ্রেম ও সম-অধিকারবোধ প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত। তবে প্রায়ই তা বিকশিত হয় না। ভিন্নভাবে সামাজিকীকরণের কারণে কতিপয় পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসী তরুণ যাতে তাদের সাম্যবোধ ও অন্তর্নিহিত বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ না করতে পারে, এ জন্য তরুণসমাজকে উদ্যমী ও সংগঠিত হতে হবে। লিঙ্গসমতার পক্ষে সোচ্চার হতে হবে; পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীর সম-অধিকার আদায়ে সহযোদ্ধা হতে হবে। চিরকাল তরুণেরাই অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছে, এখনো তারাই প্রতিবাদী হবে। তরুণেরাই দৃঢ়কণ্ঠে বলবে, সময় বদলেছে, নারী নির্যাতনের দিন শেষ হয়েছে।
প্রথম আলো: নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকোপ মোকাবিলায় বাংলাদেশ আর কী কী করতে পারে। কাদের এটা করা উচিত?
সালমা খান: বাংলাদেশ অনেক কিছু করতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটা অপরাধ। আইনেও এটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সরকারের। নারীর সুরক্ষায় যে কয়টা আইন প্রণীত হয়েছে, সব কটি আইনের প্রয়োগ করতে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও পরিহার করার জন্য আমরা যদি প্রচারণা চালাই তাহলে সাফল্য আসবে।