সেদিনও যথারীতি কাজ শেষে মধ্যরাতে বাসায় ফিরেছি। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। শোবার ঘরে ঢুকে দেখি স্ত্রী আর আমাদের দুই সন্তান। তিনজনের মুখেই গভীর একটা ষড়যন্ত্রের আভাস। একটু পর মেয়ের হাত থেকে বের হলো একটা উপহার। মোড়ক খুলে মগটা দেখতে দেখতেই ছেলে দিল আরেকটি প্যাকেট। সেটা খুলে বের হলো একটা থালা। বাবা দিবসের উপহার। গত বছরের ঘটনা।
আমি আবেগে আপ্লুত। কিশোর বয়সের দুই ছেলেমেয়ে আর তাদের মায়ের এই উদ্যোগে চোখ ভিজে আসার মতো অবস্থা। চারজনের সেলফি তোলা হলো—ফেসবুকেও দিয়ে দিলাম।
আনন্দঘন সেই ক্ষণে মেয়ের প্রশ্ন—‘বাবা, দাদাকে বাবা দিবসে তুমি কী দিলা?’ আমি লজ্জাই পেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, ‘ফোন করেছি।’ পাল্টা কথা, ‘গিফট তো দাও নাই, শুধু ফোন করলে হয়? আমরা তো তোমাকে গিফট দিলাম।’ আমি আত্মপক্ষ সমর্থনে—‘আমার এসব করতে লজ্জা লাগে। আর আমার বাবা তো ঢাকায় থাকেন না। আর আমাদের কালচারেও এসব দিবস-টিবস নেই।’
সন্তানের কথায় আসলে তো মনে মনে আমি নিজেই লজ্জা পাই। দিবস বলে কথা নয়। ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আমাদের বাড়িতে মা-বাবাই শুধু থাকেন। জীবনের তাগিদে আমার সংসার, আমার কাজ সব ঢাকাতেই। দিবস-টিবস ধরে নয়, সারা বছর কতটা খবর নিই আমার বাবার? বেশির ভাগ ফোন আব্বাই করেন। আমি তখন যত কম কথায় শেষ করা যায়, সেই ধান্দায় থাকি।
অথচ বাইরের পৃথিবী দেখা এই বাবার হাত ধরেই। সব সন্তানের মতোই আমার কাছেও আব্বা বনস্পতির মতো। ছায়া দিয়ে দিয়ে বড় করেছেন আমাকে। আজ থেকে প্রায় ২৯ বছর আগে বাড়ির পাট চুকিয়ে যখন ঢাকায় এলাম পড়াশোনার জন্য, আমাকে রেখে এক দিন পর যখন আব্বা চলে যাচ্ছেন, তখন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে হতবিহ্বল আমি। ইঞ্জিন হুইসেল দিচ্ছে, গার্ড সবুজ পতাকা ওড়াচ্ছে, যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলতে শুরু করেছে—জানালা দিয়ে মুখ বের করে আব্বা হাসছেন, নিজের আবেগ সামলে। খানিক আগেই বলেছেন, ‘চিন্তা নেই, একা থাকতে পারবি।’ এদিকে সদ্য কলেজ পার করা আমার বুকে চেপে বসল একাকিত্ব।
এখন সেই একাকিত্বের বেদনা কুরে কুরে খায় আব্বাকে। ‘অনেক দিন বাড়ি আসিস না, কবে আসবি?’ ‘আব্বা, কাজের অনেক চাপ। আর ওদের তো স্কুল খোলা। মেয়ের তো প্রোগ্রাম।’ বাড়ি যাওয়া হয় না মাসের পর মাস। তাই বলে কি বাবার প্রতি ছেলে হিসেবে আমার টান নেই! অবশ্যই আছে। ঢাকায় এখনো কোনো রেললাইন দেখলেই মনে হয়, আরে, এই রেললাইনই তো আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে। ঢাকা টু সরিষাবাড়ী বাস দেখলেই মনে হয় এই বাসের চাকায় মিশে আসে আমার বাড়ির ধুলো-মাটি-কাদা। অনুভূতি, অনুভব সবই আছে কিন্তু যাওয়াটা সব সময় হয় না। প্রকাশটাও হয়তো প্রগাঢ় নয়।
স্নেহ নিম্নগামী। বাবাকে আমরা আকাশ কিংবা বটবৃক্ষের মতো দেখে আসি। সেই আকাশে ঢিল ছোড়া যায়, ঘুড়ি ওড়ানো যায়—সেই বটবৃক্ষের ডালে ওঠা যায়, ঝুড়িতে ঝুলে দোল খাওয়া যায়। কোথাও কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই, সব সময়ই ছায়া দেবে এই বনস্পতি। ‘বাবাই তো, আমি সামনে গেলে রাগটা পড়েই যাবে।’ তাই বাবার প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধার প্রকাশ না করলেই-বা কী! উল্টো দিকে ছেলে বা মেয়ের আবদারই আমরা আগে মেটাই। ওদের কোনো অপ্রাপ্তি যেন না থাকে। বাইরে কয়েক ঘণ্টা একা থাকলেই মনটা যেন কেমন করে।
আমার প্রতি আমার বাবার চাওয়া-পাওয়া, অধিকার একটু বেশিই। কারণ, আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার আর কোনো ভাই-বোন নেই। যে কেউ শুনলেই বলে, এক বাপের এক ছেলে—আপনার আর চিন্তা কী!
চিন্তা তেমন নেই, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কিছুটা জটিলই। মাসখানেক আগে আমার এক বাল্যবন্ধু আমাকে ফোন করল। সে বলল, ‘তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম। চাচা-চাচি একা থাকেন। তুমি আসো না কেন?’ আমি বলি, ‘ঈদেই তো গেলাম। নিয়মিত খোঁজ নিই। চাকরি, ঢাকার জীবন, সংসার—চাইলেই কি আর যাওয়া যায়?’ বন্ধু আরও কিছু কথা বলতে থাকে, আম মনে মনে বলি, ‘মায়ের চেয়ে যেন মাসির দরদ বেশি’। ফোন ছাড়ার পর কিন্তু মনটা ভারী হয়ে যায়। আসলেই তাঁদের তো আর কেউ নেই। আবার এদিকেও তো ঝামেলা কম নেই। সব সামলে ঘন ঘন তো যাওয়াও যায় না।
প্রতিটি ঈদ আমাকে বাড়িতে গিয়েই করতে হয়। কিন্তু আমার স্ত্রীরও ইচ্ছা করে তাঁর বাবার বাড়ি ঈদ করতে। কিন্তু ওই যে আমি ‘একমাত্র’, মা-বাবার তো আমি, আমার ছেলেমেয়ে, আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। তাই ঈদ নিজের বাড়ি ছাড়া করার বিকল্প আমার নেই। স্ত্রীর কষ্টটা বুঝি, নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। ঈদের এক বা দুদিন পর যাই শ্বশুরবাড়ি। স্ত্রী হয়তো ঈদের আগে বা পরে কয়েক দিন বেশি থেকে আসে তার বাবার বাড়ি।
বাবার বয়স হয়েছে। অসুস্থতাও আছে। ছোটবেলায় কোনো কিছু বাবাকে না বলে থাকতে পারতাম না। এখন ছোটখাটো কিংবা বড় অসুখেও জানাই না। জানালে তাঁদের উৎকণ্ঠাই বাড়ে। আবার বাবারও ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ আমার অজানা থাকে। জরুরি ওষুধ শেষ হলে ফোন আসে—‘ইনসুলিন পাঠা। আজই।’ শিশুর মতো আবদার। ইনসুলিন পাঠানোর মেকানিজমও একটা তৈরি করা আছে। তারপরও মাঝেমধ্যে দীর্ঘদিন না দেখার অভিমানে আব্বা বলতে থাকেন, ‘আমাকে আর কে দেখবে?’
স্নেহ আরও নিম্নগামী হয় বাবার বেলায়। ছেলে, ছেলের পর নাতি-নাতনির প্রতি স্নেহের সেই ধারা বইতে থাকে। আমরা বাড়ি যাচ্ছি, শুনলেই শরীরে কুলাক আর না কুলাক, আব্বা নিজেই যাবেন বাজারে। প্রত্যেকের প্রিয় খাবারের জিনিসগুলোই কিনে আনেন। বাড়ির সামনে পায়চারি করতে থাকেন কখন আমরা পৌঁছাব। এ কথা ঠিক, আমি বাবার প্রতি শতভাগ দায়িত্ব হয়তো কখনোই পালন করতে পারব না। কিন্তু আমাদের প্রতি তিনি শতভাগ দায়িত্বই পালন করেন—যত দিন থাকবেন, তত দিন করেই যাবেন। কারণ, বাবারা তো এমনই।
আমরা অনেক সময় সংসার, কাজকর্মের চাপে ভুলেই যাই বাবার বয়স হয়েছে। বনস্পতি বাবা এখন সন্তানের ভরসা চান। বাবা আছেন তাই হয়তো আলাদা করে বুঝতে পারি না বাবার জন্য টানটা কোথায়? যখন বুঝবো তখন হয়তো নিজের ছেলের কাছে বাপ হয়ে আবদার করব। তা না হলে আমার ৭৮ বছর বয়সী বাবা কেন আমার কাছে আবদার করবেন—‘আমাকে একবার আমার বাবার ভিটেয় নিয়ে চল। একবার দেখে আসি।’