সারা দেশের পৌরসভায় পাঁচ পৌরমাতা

সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জের মেয়রই নারী। সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো ওই সিটির মেয়র নির্বাচিত হলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। কোনো সিটিতে পরপর তিনবার কোনো নারীর মেয়র হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। আইভী এখন আর একা নন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই মুহূর্তে পৌরসভার নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাঁচ নারী মেয়র। রীতিমতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পৌরসভার অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা

‘পৌরপিতা’ শব্দবন্ধটিই বলে দেয় পৌরসভার চেয়ারম্যান বা মেয়রের পদটি এত দিন পুরুষদের একচেটিয়া ছিল। ব্যাপারটা এমন যে এসব পদে কোনো নারী কখনো আসবেন না। পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুনের সোজা কথা, ‘এসব শব্দ পাল্টানোর সময় এখন এসেছে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা থেকে এসব শব্দের উদ্ভব।’

প্রথমবার কোনো নারী হিসেবে দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হলেন জাকিয়া খাতুন। তাঁর জন্ম ও পড়াশোনা দিনাজপুরে হলেও বিয়ের সূত্রে এখন তিনি পঞ্চগড়ের স্থায়ী বাসিন্দা। কলেজজীবনে রাজনীতির হাতেখড়ি। বিয়ের পর পঞ্চগড়ের একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেও রাজনীতি ছাড়েননি। ২০১৫ সালে প্রথমবার পৌর মেয়র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং হেরে যান। কিন্তু হার তাঁকে দমাতে পারেনি। ২০২০ সালে আবারও নির্বাচন করেন এবং জয়ী হন। সব কাজে স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের অকুণ্ঠ সহযোগিতার কথা বললেন বার কয়েক।

জাকিয়া খাতুন

পঞ্চগড়ের পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও পৌরসভায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনে মেয়র হন আঞ্জুমান আরা বেগম। তাঁরও দিনাজপুর শহরে জন্ম, পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে যায়। তবে বিয়ের পরও পড়াশোনা বন্ধ করেননি। উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক করেছেন। পড়েছেন আইনশাস্ত্রেও। একসময় সাংবাদিকতা করতেন। স্বামী এ টি এম শামসুজ্জোহার পেশা এখনো সাংবাদিকতা। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি স্কুলও করেছেন। প্রথম দফাতেই কিন্তু মেয়র পদে লড়াইয়ে নামেননি আঞ্জুমান আরা। এর আগে কাউন্সিলর ও সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদে লড়েছেন। তারপর মেয়র হলেন।

আঞ্জুমান আরা

দুই সন্তানের মা আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘মেয়রের কক্ষে মেয়রদের নামের তালিকার যে বোর্ড আছে, সেদিকে তাকাতে ভালো লাগে। এই প্রথম সেখানে নারীর নাম যুক্ত হয়েছে। নিজের নাম আছে, সে জন্য তো বটেই, তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে কোনো নারীর নাম সেখানে যুক্ত হয়েছে, এ কথা ভেবে।’

পৌরসভায় একজন নারীর নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মেয়েদের বেশ নাড়া দিয়েছে। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঠাকুরগাঁওয়ে একাধিক নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জেলার পীরগঞ্জের একটি ইউনিয়নে জয়ও পেয়েছেন এক নারী।

নাটোর পৌরসভার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই মেয়াদে জয়ী হলেন উমা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো পুরুষও একনাগাড়ে দ্বিতীয়বার মেয়র বা চেয়ারম্যান হতে পারেননি। যেটা আমি হলাম। এ জন্য দল এবং নাটোর পৌরসভার সব মানুষকে ধন্যবাদ জানাই।’

উমা চৌধুরী

একটি রাজনৈতিক পরিবারেই উমা চৌধুরীর জন্ম। বাবা প্রয়াত শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং নাটোর সদর আসনের সাংসদ ছিলেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাবার সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তিটা ধরে রাখতে চান উমা। সেই সঙ্গে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে চান দায়িত্ব।

উমা চৌধুরী বলছিলেন, ‘নারীরা পুরুষদের তুলনায় ধৈর্যশীল। এই ধৈর্যশীলতা তাঁদের সততা বজায় রাখতে সহযোগিতা করে। আমার মনে হয়, দায়িত্ব পালনে নারীরা বেশি মনোযোগী।’

স্থানীয় সরকার নিয়ে মাঠপর্যায়ের একাধিক গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। তিনি বলেন, নারী নেতৃত্ব অপেক্ষাকৃত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে বলে জনমনে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। গত তিন দশকে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তাতেই এই ধারণার উদ্ভব। এখানে দুজন নারীর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকাও একটি প্রভাব রেখেছে।

নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা অনেকটা পাল্টেছে বলে মনে করেন নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আকতার জাহান।

রাফিকা আকতার জাহান

স্বামী আকতার হোসেনের মৃত্যুর পরই রাজনীতিতে আসেন রাফিকা। তাঁর বাবাও রাজনীতিতে ছিলেন। বাবা ও স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একসময়ের এই গৃহিণীকে সহায়তা করেছে বিস্তর, স্বীকার করলেন। প্রায় এক লাখ ভোটারের পৌরসভায় মেয়রের কাজ দায়িত্ব নিয়েই পালন করেন তিনি। রাফিকা আকতার জাহান বলেন, ‘রক্তে রাজনীতি আছে। তাই তেমন কোনো সমস্যা হয় না। রাজনীতি দেখে বড় হয়েছি। এই পরিবেশ আমার জন্য নতুন নয়।’

রাজনীতিক স্বামীর অকালমৃত্যুর পর নির্বাচন করে জয়পুরহাটের কালাই পৌরসভার মেয়র হন রাবেয়া সুলতানা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর এলাকায় নির্বাচন হয়। রাজনীতি থেকে দূরের মানুষ ছিলেন। সময় ও পরিস্থিতি তাঁকে এ পথে এনেছে। সে জায়গায় নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারবেন, এ বিষয়ে প্রত্যয়ী রাবেয়া সুলতানা। বললেন, ‘নারী হিসেবে বিশেষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, তা বলব না। প্রতিকূলতা এলে রুখে দাঁড়ানোর মতো শক্তি সঞ্চয় করেছি।’

রাবেয়া সুলতানা

শুধু রাবেয়া সুলতানা নন, বাকি নারী মেয়রদের চাওয়াও অনেক বড়। সব ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। সুযোগ পেলে নারীরা যে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে জনগণের মন জয় করতে পারেন, তার উদাহরণ তো নারায়ণগঞ্জেই বর্তমান। সেটা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পালা। যে ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন পৌরসভার এই পাঁচ ব্যতিক্রম মেয়র।