চিকিৎসক বলেছিলেন বাচ্চা বাঁচার সম্ভাবনা কম। মাকে বাঁচাতে হলে অস্ত্রোপচার করতে হবে। হাসপাতালে নয়, বাড়িতে নয়, সেই মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে চলন্ত ট্রেনে। সেখানেই মিলেছে চিকিৎসক। প্রসবে সহযোগিতা করেছেন একজন নারী আইনজীবী। এখন মা ও নবজাতক দুজনেই ভালো আছেন।
এ যেন বলিউডের সিনেমা থ্রি ইডিয়টস–এর আরেকটি দৃশ্য। সিনেমায় সন্তান প্রসব হয়েছিল টেবিল টেনিস টেবিলে। আর প্রসবে সহযোগিতা করেছিলেন প্রকৌশলীরা। ট্রেনের মতো সেখানেও একজন নারী চিকিৎসক ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন ভিডিও ক্যামেরার অপর প্রান্তে। সিনেমার ঘটনাটি ঘটেছিল দুর্যোগপূর্ণ রাতে। ট্রেনের ঘটনাও রাতের। টিকিট না পেয়ে ট্রেনের দরজার সামনে শুয়ে পড়েছিলেন মা। ভেবেছিলেন এভাবেই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রাজশাহী যাবেন।
১৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা থেকে ছেড়ে আসা সাগরদাড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজশাহী স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সাবিনা ইয়াসমিন দ্বিতীয় কন্যার মা হয়ে গেছেন। আগে থেকেই স্টেশনে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স। সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
১৭ সেপ্টেম্বর সকালেই একটি হরলিক্সের কৌটা নিয়ে হাজির হয়েছেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক আবদুল করিম। রক্তের প্রয়োজন ছিল, তারও ব্যবস্থা করলেন। তিনি বলেন, ‘মেয়েটির নাম তাঁরাই রাখবেন। ও বড় হয়ে যাতে ট্রেনের শোভন শ্রেণিতে সারা দেশে বিনা মূল্যে ভ্রমণ করতে পারে, তার জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।’ ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে রেলভবনে মা–মেয়েসহ চলন্ত ট্রেনে যাঁরা সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সম্মানে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।
সাবিনা ইয়াসমিনের বয়স ২৮ বছর। বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার কামালপুর গ্রামে। স্বামী কৃষক। দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই সাবিনা শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ঘটনার আগের দুই সপ্তাহে দুই দিন করে চার দিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন চিকিৎসক আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন—এই প্রসূতির জটিলতা রয়েছে। স্বাভাবিক প্রসব হবে না।
১৭ সেপ্টেম্বর সকালে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা সাবিনা ইয়াসমিন তার কথা বলছিলেন। তিনি খুবই খুশি। কথা বলছিলেন হেসে হেসে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট বোন জেসমিন আক্তার ও জা জুলেখা খাতুন।
আগামী ১৭ অক্টোবরে সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ছিল সাবিনার। ঝুঁকি না নিয়ে ১ অক্টোবর অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ১৪ সেপ্টেম্বর সাবিনার ব্যথা শুরু হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে গেলে তাঁকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইনজেকশন দেওয়া হয়। তাতেও ব্যথা কমে না।
বাড়িতে নিয়ে আসার পর মনে হয়েছিল তিনি মারা যাবেন। তখনই রাজশাহীতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে জেসমিন আর জুলেখা। বাড়ি থেকে স্টেশন পাঁচ–ছয় কিলোমিটার দূরে। অটোরিকশায় স্টেশনে আসার পর সাবিনা বমি করা শুরু করেন। অবস্থার অবনতি হতে থাকলে তারা ভেড়ামারায় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। রোগীর অবস্থা দেখে চিকিৎসক বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। আবার তারা স্টেশনে যান। রাত আটটায় সাগরদাড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনটি এল, কিন্তু কোনো আসন খালি নেই। টিকিট পাওয়া গেল না। টিকিট ছাড়া এই ট্রেনে যাত্রী নেওয়া হয় না। তবু জেসমিন আর জুলেখা জোর করে সাবিনাকে ট্রেনে তোলেন। তারা ‘ছ’ ও ‘জ’ বগির মাঝখানের জায়গায় তাঁকে শুইয়ে দেন।
ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট সাব্বির রহমান ট্রেনের ভেতরে সবটা সামলিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘ট্রেন আবদুলপুর স্টেশন ছাড়ার পরে একজন যাত্রী এসে আমাকে জানান এক মেয়ের বোধ হয় বাচ্চা হবে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। শুনেই আমি সেখানে যাই। দেখি লোকজন ভিড় করছেন। সব পুরুষ মানুষকে বুঝিয়ে সরিয়ে দিই।’
এরপর সাব্বির ‘ছ’ বগির কয়েকজন যাত্রীকে ‘চ’ বগিতে পাঠান। আর গেটের কাছে দুটি ওড়না বেঁধে দেন। এ সময় পেশায় আইনজীবী মুক্তা রানী কর্মকার সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তিনি এসে প্রসূতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করতে থাকেন। আড়ানী স্টেশনে ক্রসিংয়ের জন্য ট্রেন দাঁড়াল। এ সময় সন্তানের জন্ম হয়ে যায়। কিন্তু ফুল (প্লাসেন্টা) পড়েনি। তখন ট্রেনে ঘোষণা করা হয়, যাত্রীদের মধ্যে কোনো চিকিৎসক আছেন কি না। পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে একজন নারী চিকিৎসক এলেন। তিনি এসে নাড়ি কাটলেন। ফুল অপসারণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করলেন। ততক্ষণে ট্রেন রাজশাহী স্টেশনে পৌঁছে গেছে। আগে থেকে কর্তৃপক্ষকে বলে রাখা হয়েছিল এই ট্রেন যেন আড়ানী থেকে রাজশাহী যেতে কোনো ক্রসিংয়ে না পড়ে। আগে থেকেই ফোন করে স্টেশনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি তাঁদের নিয়ে হাসপাতালে যান। সঙ্গে সেই আইনজীবী মুক্তা রানী কর্মকারও যান। হাসপাতালে ভর্তি করে তারপর বাসায় ফেরেন।
সাবিনার ছোট বোন জেসমিনের কাছে পাওয়া গেল মুক্তা রানী কর্মকারের ফোন নম্বর। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরদী। তিনি পাবনা কোর্টের একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী। স্বাস্থ্যবিষয়ক একটি চাকরির দুই বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
ট্রেনের চিকিৎসক কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর দিয়ে যাননি। তবে ১৭ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে তাঁর খোঁজ মেলে। চিকিৎসকের নাম ফারজানা তাসনিম। বাড়ি রাজশাহীর উপশহর এলাকার দুই নম্বর সেক্টরে। তিনি বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। ৪২তম বিসিএসে সুপারিশ পেয়েছেন। ফারজানা বললেন, ‘চিকিৎসক সম্প্রদায়ের একজন সদস্য হিসেবে একটা দায়িত্ববোধ থেকেই ঘোষণা শোনামাত্রই ‘ঞ’ বগিতে নিজের লাগেজ রেখে ছুটে যাই।’
সন্তানসহ মা সাবিনা ইয়াসমিন ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গেছেন। মা–মেয়ে দুজনই এখন সুস্থ।