মানুষের উচ্চতা তাঁর স্বপ্নের সমান। একদিন যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলাম, আজ তা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। আজ আমরা বলতেই পারি, আমাদের স্বপ্ন এখন অনেকটাই বাস্তব।
আমি শৈশব থেকেই শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, হতে চেয়েছিলাম মানুষ গড়ার কারিগর। মা প্রয়াত সোফিয়া মান্নান খান ছিলেন শিক্ষক। তাঁকে দেখেই হয়তো আমার ভেতর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন জেগে থাকবে। আমাদের পারিবারিক পরিবেশ ছিল সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক। আমার বাবা প্রয়াত আবদুল মান্নান খান ও মা আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব যত্নশীল ছিলেন। আমার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল মিশনারি স্কুলের ছক কাটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। আম্মা চাইতেন, আমরা ভালো ইংরেজি শিখব, তবে মাতৃভাষার গুরুত্বকে খাটো করে নয়। আমার ভেতর শিক্ষক হওয়ার প্রবল আগ্রহটা তৈরি করেন আমার আব্বা এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা আমাকে ডানা মেলতে সাহায্য করে। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফল করেও শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়নি।
স্বপ্ন বদলে গেল। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। স্কুল গড়ে তুলব। বন্ধু জিনাত আফরোজা সব জানত। ঠিক হলো, ওদের ধানমন্ডির বাড়ির একতলায় স্কুল করব। আব্বা সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না, ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি। জিনাত, আমি এবং আরও দুই বন্ধু মিলে ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে (পয়লা বৈশাখ) ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়িতে সানিডেইল স্কুলের যাত্রা শুরু করলাম।
শুরুতে বাংলা মাধ্যম স্কুল হিসেবে চালু হলেও ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে সানিডেইল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পরিণত হয়। ১১ ছাত্রছাত্রী নিয়ে সানিডেইলের পথচলা শুরু হয়। প্লে গ্রুপ থেকে নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন ওয়ান, কিন্ডারগার্টেন টু—এভাবে সানিডেইলের শ্রেণির ও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ১৯৯৭ সালে আমাদের স্কুলের প্রথম অর্ডিনারি লেভেল (ও লেভেল) ব্যাচের মাত্র পাঁচ শিক্ষার্থী যুক্তরাজ্য সরকার অনুমোদিত এডেক্সেল এক্সামিনেশন বোর্ডের অধীনে জিসিই পরীক্ষা দিয়ে প্রশংসনীয় ফলাফল করে। ২০০৭ সালে এডেক্সেলের পাঠ্যক্রম অনুসারে অ্যাডভান্সড লেভেল চালু হয়। ২০০৮ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধীনে পরিচালিত কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এক্সামিনেশনের পাঠ্যক্রম অনুসারে অর্ডিনারি এবং অ্যাডভান্সড লেভেলের (এ লেভেল) পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করি আমরা।
আমার সব সময় স্বপ্ন ছিল, সানিডেইলের নিজস্ব ভবন হবে। চেষ্টা করেছিলাম সরকারের কোনো একটি প্রকল্পে জায়গা নিতে। রাজউকের পাঁচটি প্রকল্পের জমি পেতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা বসুন্ধরার–বারিধারা প্রকল্পে ১৫২ কাঠা জমি কিনতে সমর্থ হই। নানান বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই জমির ওপর এখন দাঁড়িয়েছে স্কুলের প্রথম ভবন। চারটি ভবন তৈরির ইচ্ছা আমাদের। প্রথম ভবনে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস শুরু হবে ২০২২ সালের জুলাই সেশন থেকে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এ ভবন। দ্বিতীয় ভবনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে এ ভবনে প্লে গ্রুপের ক্লাস আরম্ভ হবে। ২০২৪ সালে নার্সারি থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসও পর্যায়ক্রমে নতুন ভবনে স্থানান্তরের পরিকল্পনা আছে আমাদের। পুরো ক্যাম্পাস চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে আর্লি লার্নিং (শিশু শ্রেণি থেকে কিন্ডারগার্টেন টু), দ্বিতীয় অংশে জুনিয়র (প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি), তৃতীয় অংশে মিডেল (পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি) এবং শেষ অংশে থাকবে সিনিয়র সেকশন (নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি)।
নিজস্ব ভবন না থাকায় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অর্ডিনারি এবং অ্যাডভান্সড লেভেলের পরীক্ষার ভেন্যু দিতে পারিনি। এত বছর আমাদের শিক্ষার্থীরা ব্রিটিশ কাউন্সিল নির্ধারিত বিভিন্ন কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছে আমরা। এখন থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা নিজস্ব স্কুল ভবনে পরীক্ষা দিতে পারবে, এ কথা চিন্তা করলেও আনন্দে মনটা ভরে ওঠে।
কেবল ভবন নির্মাণ নয়, নির্মিত ভবনে যেন আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকে, উপযুক্ত ব্যক্তিদের পরামর্শে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের শ্রেণিকক্ষ তৈরির লক্ষ্যে প্রতিটি কক্ষে মাল্টিমিডিয়া সুবিধা রাখা হয়েছে। থাকবে কম্পিউটার ল্যাব। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সর্বাধুনিক সুবিধাদিসহ সায়েন্স ল্যাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সবার, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পুরো ক্যাম্পাসে অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপণ পদ্ধতি স্থাপন করা হয়েছে। যেন কখনো অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটলেও মূল্যবান জীবন ও সম্পদের ক্ষতি না হয়।
আমাদের নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, মেধা ও মনন বিকাশের উপযোগী অবকাঠামো রাখা হয়েছে। প্রশস্ত ও প্রসারিত সবুজ মাঠের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুলের মাঠ যেন কেবল শিক্ষার্থীদের খেলার জন্য নয়, তাদের দৃষ্টিশক্তি, চিন্তাজগৎ ও কল্পনার দিগন্ত প্রসারে সহায়ক হয়, সেটাই আমাদের চাওয়া। নির্ধারিত দিনে মাঠে কো–কারিকুলামের মধ্যে শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম, তাইকোয়ান্দো, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল, ফুটবল, ক্রিকেট, ইনডোর গেমস, দাবা, ক্যারম, টেবিল টেনিস এবং নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা প্রভৃতি শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সমগ্র দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কল্পনাতীত এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ কঠিন সময়ে আমরা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে যুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে আমরা পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করি। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও স্কুলের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন। মহামারির আঘাত আমাদের কেবল এক অচিন্তনীয় পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেনি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ অন্বেষণ ও তা বাস্তবায়নের এক জটিল আবর্তেও ফেলে দেয়। আমরা শিক্ষকদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। আগে যেখানে শিক্ষকেরা একটা নির্দিষ্ট সময়, সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত স্কুলে দায়িত্ব পালন করতেন, এখন তাঁদের বাড়িতে থেকে দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে। এক দিকে যেমন আমরা অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা নিচ্ছি, অপর দিকে এ ব্যবস্থার সার্থকতা নিরূপণের চেষ্টাও করছি। আমাদের অভিজ্ঞ একদল শিক্ষক অনলাইন ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা প্রতিনিয়ত ভুল থেকে সংশোধন ও সংশোধন শেষে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এ পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছি। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়া ও মূল্যায়ন কার্যক্রম সফল করা সম্ভব হতো না, যদি আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা আমাদের সাহায্য না করতেন। আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। অনলাইন ক্লাস যত ভালোই হোক, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে পেতে চাই। শিক্ষকের প্রাণ তাঁর ছাত্রছাত্রী। আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের কলরবে স্কুলের প্রাঙ্গণ ভরে উঠুক। সরকার ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমরাও কাজ শুরু করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথোপযুক্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা আমাদের সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল। আমাদের আশা পূর্ণ হয়েছে। এবারও সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পেলাম।
আমার সারা জীবনের স্বপ্ন, মানসম্মত শিক্ষা এবং নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের চেষ্টা সফল হচ্ছে—এই দাবি আমরা বিনয়ের সঙ্গে করতে চাই। সানিডেইলের শিক্ষার্থীরা আজ বিশ্বময় ছড়ানো। তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখছে। বেশ কিছুদিন আগে প্রাক্তন ছাত্র নুরুল আজীম এসেছিল স্কুলড্রেস পরে। ওই পোশাকে তাকে দেখে আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। প্রিয় পোশাকটি সে সযত্ন রেখেছে স্কুলকে ভালোবেসে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যখন তাদের স্বজন বা সন্তানকে ভর্তির জন্য নিয়ে আসে, অন্য এক অনুভূতির প্রকাশ দেখতে পাই। ছাত্র থাকাকালে স্কুলের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা অনেক সময় ক্ষোভের সৃষ্টি করলেও স্কুল ছেড়ে গিয়ে সেগুলোই তারা পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের চাওয়া আর কী হতে পারে!
ঢাকা শহরে নিজস্ব ভবনে মানসম্মত একটি স্কুল পরিচালনার স্বপ্ন প্রায় আকাশ ছোঁয়ার মতো। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানান প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাদের। সবার সাহায্য, সহযোগিতা ও পরামর্শে সেসব কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করেছি। ধাপে ধাপে এগোনোর পেছনে স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক, অভিভাবক এবং সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সীমাহীন অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের আন্তরিকতা ছাড়া স্কুল এ পর্যায়ে আসতে পারত না। আমি আশা করি, বসুন্ধরায় নিজস্ব ভবনে স্কুল স্থানান্তরের কঠিন কাজেও আমরা সফল হব। এ প্রার্থনাই করি বিশ্বজগতের প্রভুর কাছে।
আর কত দিন বাঁচব জানি না। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, সবুজ মাঠ, মাঝখানে লাল ইটের দুটি ভবন। মাঠে খেলছে সাদা শার্ট আর নেভি ব্লু স্কার্ট বা নেভি ব্লু প্যান্ট পরা ছোট ছোট শিশু। শিক্ষকের সব স্বপ্ন তাঁর শিক্ষার্থীদের ঘিরে। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি তারা মানবিক ও দেশপ্রেমিক হবে, দেশ ও দশের মঙ্গলে কাজ করবে, এ আমাদের ঐকান্তিক চাওয়া। প্রিয় শিক্ষার্থীদের চোখে জীবনের নানান রঙের স্বপ্ন ভাষা পাবে, তাদের স্বপ্নগুলো আকাশে ডানা মেলবে—এটাই আমার প্রত্যাশা।