ঘোরাঘুরি

সাদা বৃষ্টির দেশে

গ্যাংটক শহর থেকে চাঙ্গু হ্রদ যাওয়ার পথে এমন দৃশ্য। ছবি: লেখক
গ্যাংটক শহর থেকে চাঙ্গু হ্রদ যাওয়ার পথে এমন দৃশ্য। ছবি: লেখক

বাংলাবান্ধা পেছনে ফেলে ততক্ষণে আমরা ভারতের ফুলবাড়ীতে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার এ স্থলবন্দর পেরিয়ে মনে হলো—শুধু দেশ নয়, সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে সময়েও। কারণ, ঘড়িতে সময়ের ফারাক তখন স্পষ্ট।

ফুলবাড়ী থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো, আর শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের গ্যাংটক চার ঘণ্টার পথ। আমাদের গন্তব্য গ্যাংটক। পুরো পথে সঙ্গী হলো তিস্তার সবুজ পানি! গাড়ির চালক তখন হিন্দি শাস্ত্রীয় সংগীত বাজাচ্ছেন। আমরা মুগ্ধ চোখে তিস্তার দিকে চেয়ে আছি। কতক্ষণ এভাবে পেরিয়ে গেছে জানি না, হঠাৎ করেই তিস্তার বুকে বিশাল এক কংক্রিটের স্থাপনা আমার ফুরফুরে মনটাকে বিষণ্ন করে তুলল।

হায় তিস্তা ব্যারাজ! চালক হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবু, কী হয়েছে? হঠাৎ করে বিষিয়ে গেলেন যে?’ জবাব দিলাম বাংলায়, ‘তোমার দেশে তিস্তার পানি মাতলামো করে আর আমার দেশে তিস্তা ধু ধু বালুচর।’

সিকিমে প্রবেশ

সিকিম রাজ্যে প্রবেশের জন্য বিদেশি নাগরিকদের আলাদা অনুমতি নিতে হয়। সে অনুমতি নিজ দেশ থেকেও নেওয়া যায়। সময় খরচ করতে চাইনি বলে সিকিমে ঢোকার মুখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা চেকপোস্টে যেতে হলো—রংপো চেকপোস্ট। বিদেশিদের নাম নিবন্ধনের কার্যালয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন কর্মকর্তা নিজেই ফরম পূরণ করে পাসপোর্টে সিকিম ভ্রমণের অনুমতি সিল লাগিয়ে দিলেন।

গ্যাংটকে পা

সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে যখন পা রাখলাম, তখন শেষ বিকেলও পেরিয়ে গেছে। এই গ্যাংটকেই তো ফেলুবাবু গন্ডগোলের সমাধান করে গিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের বই গ্যাংটকে গন্ডগোল চোখের সামনে ভেসে উঠল।

আমাদের হোটেল এমজি মার্গে, স্থানীয়রা বলে ম্যাল রোড। গুগল ম্যাপস বের করে সেদিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম, ইচ্ছে করেই ট্যাক্সি নিইনি। পুরো শহরটা পাহাড়ের ওপর, কাঠের বাড়ি বেশির ভাগ, কিন্তু পাঁচ–ছয়তলা ভবনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। রাস্তাগুলো হয় ওপরে উঠেছে, নয়তো সোজা নিচে নেমে গেছে, সব দোকানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে।

ইয়ামথাং উপত্যকায়

সোনার পাহাড়

গ্যাংটকে তাপমাত্রা তখন ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমার জন্য সেটা হাড় কাঁপানো শীত। এর মধ্যেই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছি। উদ্দেশ্য একটাই, কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখা।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য অবশ্য বেশি দূর যেতে হয় না। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালেই চোখের সামনে ধরা দেয় সোনালি দেবতা, কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘা কেন কাঞ্চনজঙ্ঘা সেটা একদম প্রথম দেখাতেই বুঝে গেলাম, ভোরের আলো পুরো পর্বতটাকে যেন সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। কাঞ্চন শব্দের অর্থ সোনা। দার্জিলিং আর গ্যাংটকের আদি অধিবাসীরা তো সাধে এই কাঞ্চনদেবের পূজা করত না আগে, ভোরের আলোয় যখন পুরো পর্বত সোনায় মুড়িয়ে যায়, তখন যে কেউ তাকে দেবতা ভেবে ভুল করবে না। এই সৌন্দর্য স্বর্গীয়

গেদের সঙ্গে লাচুং

সিকিম রাজ্যে মোট জেলা চারটি—উত্তর সিকিম, দক্ষিণ সিকিম, পূর্ব সিকিম, পশ্চিম সিকিম। লাচুং পড়েছে উত্তর সিকিমে। এখানে যাওয়ার জন্য আবার আলাদা করে গ্যাংটক থেকে অনুমতি নিতে হয়। সন্ধ্যায় হোটেলে এসে অভ্যর্থনাকক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়েছিলাম, তারাই অনুমতির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সকালে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি, এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে গেদে হাজির হলেন। গেদে আমাদের গাইড। হ্যাংলা–পাতলা শরীরের সঙ্গে দিলখোশ হাসিতে বেশ লাগে তাঁকে।

গ্যাংটক থেকে লাচুং ১১৬ কিলোমিটার পথ। পাহাড়ি রাস্তা, তাই সময় লাগল প্রায় আট ঘণ্টা। লাচুং কোনো শহর নয়, একটা গ্রাম। আমাদের গন্তব্য লাচুং থেকে আরও দূরে, ইয়ামথাং উপত্যকায়। সেখানে যেতে লাচুংয়ে এক রাত কাটানো আবশ্যক।

কারণ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গ্যাংটক প্রায় ৫ হাজার ৫০০ ফুট, আর ইয়ামথাং উপত্যকা ১৬ হাজার ৮০০ ফুট। সেখানে সুস্থভাবে পৌঁছাতে হলে আগে শরীরকে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় তো দিতে হবে। গ্যাংটক ছাড়ার একটু পর থেকেই কানে তালা লাগতে শুরু করে দিয়েছে। গেদে আমাকে অস্বস্তিতে দেখে বললেন, ‘সাহেব, ঢোক গিলেন, ঠিক হয়ে যাবে।’ আমারও চট করে আরও একবার গ্যাংটকে গন্ডগোলের কথা মনে পড়ে গেল। এভাবেই তো ফেলুদা তোপসেকে কানে তালা লাগার সমাধান দিয়েছিলেন!

দুপুরের দিকে মেঘলা আকাশ তার আসল রূপ দেখাল, বর্ষা। পানির সঙ্গে পড়ছে কুচি কুচি বরফ, সাদা বৃষ্টি। আমার প্রথম তুষারপাত দর্শন। গেদে বৃষ্টির কারণে বেশ বিরক্ত, বরফকুচি মেশা পানিতে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার। আমি গেদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। গেদেকে বাংলাদেশের বৃষ্টির গল্প শোনালাম। বললাম, আমার দেশে বৃষ্টি মানে প্রেম, বৃষ্টি মানে স্মৃতিবিলাস।

ছোটবেলায় কীভাবে বৃষ্টিতে গোসল করতাম সে গল্প শোনালাম তাঁকে। গোসলের কথা শুনে গেদে শিউরে উঠলেন। এখন তাপমাত্রা
শূন্যের চেয়েও ১০ ডিগ্রি নিচে। এ দেশের মানুষ বৃষ্টিতে গোসল করার কথা শুনে শিউরে না উঠলে কে
শিউরে উঠবে?

বিকেল নাগাদ কালো মেঘ সরে গেল। রোদ আর ওঠেনি অবশ্য। এর মধ্যে ল্যান্ড রোভারের জানালা দিয়ে থেকে থেকে দূরে ইয়ামথাং উপত্যকার সাদা পর্বতচূড়াগুলো দেখা যাচ্ছে। লাচুং পৌঁছাতেও আর বেশি সময় বাকি নেই। সারা দিনের ভ্রমণে শরীর একদম ক্লান্ত, চোখ বুজলেই ঘুম চলে আসবে এমন অবস্থা, কিন্তু চোখ বুজতে পারছি না। গেদে হেসে বললেন, ‘ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নেই, বাবু। সিকিমের সৌন্দর্য আপনাকে ঘুমাতে দেবে না।’ জবাবে আমি একটা আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলাম। আহা, এ বসুন্ধরা!