ক্যামেরায় সাগরতলের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের গল্প তুলে আনেন শরীফ সারওয়ার। গভীরতম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডসহ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ছবি তুলেছেন জলতলের এই আলোকচিত্রী। সমুদ্র নিয়ে গবেষণার কাজে তাঁর তোলা ছবি ব্যবহার করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে তিনি এ কাজে এসেছেন রোমাঞ্চের টানে।
বঙ্গোপসাগর প্রশ্নে শরীফ সারওয়ারের অবস্থান একদম পরিষ্কার। সোজাসাপ্টা বলেই দিলেন, ‘বঙ্গোপসাগর আমার বাড়ি, অফিস, সংসার...!’
বঙ্গোপসাগর তাঁর কাছে এমন অনেক কিছুই। তাই বলে শরীফ সারওয়ারকে সামুদ্রিক প্রাণী ভাবার কারণ নেই! তিনি আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার—জলতলের আলোকচিত্রী। তবে তিনি আমাদের মতোই যানজট ঠেলে নগর ঢাকায় চলাচল করেন। সমুদ্র সংসার ছাড়াও স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে যাপিত জীবনের আরও দশ দিক সামলান। কিন্তু মনটা যেন নোনাজলে গড়া।
৭ মে যখন কথা হচ্ছিল, তখনো তিনি কথায় অবগাহন করেছিলেন ফেনিল সমুদ্রে। তাই হয়তো রাজধানীর ফুটপাত ধরে চলতে চলতেই তিনি ভাবেন দূর সমুদ্রের কথা। গহিন নীল জলে বেড়ে ওঠা প্রবাল, অক্টোপাস, হাজারও প্রজাতির মাছ আর নাম না জানা প্রাণীদের কথা। দিনে দিনে এরাই যে শরীফের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছে। ক্যামেরা হাতে সমুদ্রবাসীদের জীবনযাপন আর বসবাসের গল্পই যে তুলে আনেন স্থিরচিত্র আর ভিডিওতে। তাতেই ফুটে ওঠে অচেনা প্রাণীদের অজানা গল্প।
মনের নোঙর সেন্ট মার্টিনে
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তখন ছিল মোক্ষম সময়। অন্য অনেকের মতো শরীফও বেড়াতে গিয়েছিলেন সেন্ট মার্টিনে। ২০১২ সালে সেই দূর দ্বীপে গিয়েই যেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা খুঁজে পেলেন। এত দিন ধরে স্কুবা ডাইভিং আর জলের নিচের ছবি তোলার যে শখ মনে মনে গোপন করে রেখেছিলেন, তারই সুযোগ যেন খুঁজে পেলেন দূর দ্বীপে এসে। ওশানিক স্কুবা ডাইভিং সার্ভিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড তাঁকে নতুন স্বপ্ন দেখাল। যোগাযোগ করলেন সেখানেই এক কর্মীর সঙ্গে। জানতে পারলেন, তাঁদের ‘স্যার’ শুধু স্কুবা ডাইভিং শেখান না, পানির নিচে ছবিও তোলেন। সবমিলে শরীফে তো পোয়াবারো! কর্মীদের সেই স্যারের নাম এস এম আতিকুর রহমান। শরিফ পরিচিত হলেন আতিকুর রহমানের সঙ্গে।
শরীফ সারওয়ার বলে যান, ‘পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। রাজপথে রাজনৈতিক হাঙ্গামার ছবি তুলেছি। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফির কথা।’
তাঁর মধ্যে এই ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও ডিসকভারি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে এসব অনুষ্ঠান দেখতেন আর ভাবতেন, কেন তিনি এ রকম ছবি তুলতে পারেন না কিংবা চেষ্টা করছেন না। শরীফের ভাষায়, ‘ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে শিরা–উপশিরার মতো নদীর দেখা মেলে। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল সমুদ্রবেষ্টিত। এত বড় একটা অঞ্চল পানির নিচে। সেই অঞ্চলের রহস্য তো আমরা জানি না।’
এই অজানা রহস্য উন্মোচনের ইচ্ছা থেকে শুরু হলো শরীফের স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য প্রস্তুতিপর্ব, আতিকুর রহমানের হাত ধরে। পেশাদার প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তিন দিনের প্রশিক্ষণও নিলেন তিনি। এই ট্রেনিংয়ে শিখলেন কীভাবে পানিতে নামতে হয়, কীভাবে ডুবুরির পোশাক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরতে হয় এবং পানির নিচে বহন করতে হয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। কোনো দুর্ঘটনায় পড়লে কিংবা জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হয়, সে বিষয়েও পেলেন প্রশিক্ষণ।
প্রশিক্ষণ শেষে একদিন ছবি তুলতে নামলেন সমুদ্রে। কিন্তু ছবি তুলবেন কী, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতেই হিমশিম খেতে হলো। শরীরে স্কুবা স্যুট, কোমরে ওয়েট বেল্ট, পায়ে ফিনস, পিঠে সিলিন্ডার, চোখে মাস্ক, সবশেষ মুখে নিলেন শ্বাস–প্রশ্বাস নেওয়ার নল (ব্রিদিং টিউব)। প্রস্তুত শরীফ, স্পিডবোটে করে পৌঁছে গেছেন ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের কাছাকাছি। গাইড হালিমকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম ডুব দিলেন ছবি তুলতে। কিন্তু ছবি তুলবেন কী, স্বচ্ছ জলে মাছের দল এসে স্বাগত জানাল তাঁকে। ভুলে গেলেন ছবি তোলার কথা। তিনি শুধু দেখছেন...।
শরীফের কথায়, ‘এমন মুহূর্ত এখনো আসে। এত বৈচিত্র্যময়, এত স্বর্গীয় দৃশ্য সামনে চলে আসে তা হয়তো শুধু দেখার জন্যই। ছবি তোলার কথা বেমালুম ভুলে যাই তখন। ঠিক শুরুর দিনগুলোতে এমনটাই হয়েছিল।’
রোমাঞ্চের টানে
সমুদ্রের সেই মুগ্ধতা শরীফকে আজও রোমাঞ্চিত করে চলেছে। যে রোমাঞ্চের টানে চাকরি ছেড়ে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফারের মতো অনিশ্চিত পেশা বেছে নিয়েছেন। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দিনের পরদিন ছবি তুলে এনেছেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে। থাইল্যান্ডে গিয়ে নিয়েছেন উচ্চতর প্রশিক্ষণ। পেয়েছেন স্কুবা ডাইভিংয়ের আন্তর্জাতিক সনদ।
২০১২ সালে শুরু। দিনে দিনে এখন তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়েও। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগ ও ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের হয়ে আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি করেছেন। তাঁর তোলা ছবি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো মাছ, কোরাল, শৈবাল ও জলতলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করছে।
বঙ্গোপসাগর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদী, হাওর ও জলাশয়ে ছবি তুলেছেন। কর্ণফুলী নদী, মাতামুহুরী নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ, হালদা নদী, কাপ্তাই হ্রদ, লালাখাল, হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর, রামসাগর, দেবতার পুকুর, বগালেকের জীববৈচিত্র্য তুলে এনেছেন ক্যামেরায়।
তবে তাঁর মন পড়ে থাকে বঙ্গোপসাগরেই। শরীফ সারওয়ার বলছিলেন, ‘প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি–মার্চ পর্যন্ত সাগরে ছবি তোলা যায়। এই সময়টা সেন্ট মার্টিনসহ কক্সবাজার এলাকাতেই বেশি থাকি, ছবি তুলি।’ এ বছর শেষবারের মতো সেন্ট মার্টিনে গিয়েছেন মার্চের শেষ সপ্তাহে। আপাতত ঢাকাতেই আছেন। আট বছর ধরে সমুদ্রের প্রায় ২০ হাজার ছবি তুলেছেন, যে ছবিগুলো শুধু ছবি নয়, গবেষণার উপাদানও। তাই নিয়ে এখন তিনি কাজ করবেন। অপরিচিত জলজ প্রাণীর পরিচয় উদ্ঘাটন করবেন গবেষকদের সহায়তায়।
ভয়ংকর দর্শন, ভয়ংকর ডুব
ছবি তোলার জন্য সমুদ্রতলে যাত্রাটাই যে এক অনিশ্চিত যাত্রা, সেটুকু তো খালি চোখেই বোঝা যায়। তবু ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে, পানির নিচে ছবি তোলা আর নিজেকে সামলানোর যে বিজ্ঞান, তারও কিছুটা বোঝালেন শরীফ সারওয়ার।
পানির নিচে একটু হেরফের হলেই যে প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা, তার উদাহরণ দিলেন কথায় কথায়। শোনালেন সমুদ্রতলে বিষাক্ত প্রাণীর সংস্পর্শের ঘটনা। বঙ্গোপসাগরেই তিনি একবার দেখা পেয়ে গেলেন লায়ন ফিশের। বিষাক্ত কাঁটাওয়ালা এই মাছের কাঁটা গায়ে লাগলেই সর্বনাশ। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই তুললেন লায়ন
ফিশের ছবি। শুধু লায়ন ফিশের ছবিই নয়, সি আর্চিন, বৃশ্চিক মাছের (স্করপিয়ন ফিশ) মতো বেশ কিছু বিষাক্ত মাছ ও প্রাণীর ছবি তুলেছেন বিভিন্ন সময়। শরীফ সারওয়ার বলছিলেন, ‘সাগরের নিচে অনেক প্রাণীর কথাই আমরা জানি না, তাদের কোনোটা বিষাক্ত, কোনোটা ক্ষতিকর। কিন্তু সৌন্দর্য মোহিত করে তোলে। তাই সব সময়ই বিপদ সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়।’
ভয়ংকর মাছের দর্শন যেমন তিনি পেয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন সাহসী ডুবও। পৃথিবীর অন্যতম গভীরতম খাদ হিসেবে পরিচিত বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের কথা কার অজানা। তিমি, হাঙরসহ সামুদ্রিক নানা প্রাণীর এই আস্তানায় ২০১৭ সালে স্কুবা ডাইভিংয়ে নেমেছিলেন শরীফ সারওয়ার। সাহসের সঙ্গে ছবি তোলার কাজটিও করে এসেছেন তিনি।
এই সাহসের সঙ্গেই তো শরীফ সারওয়ার পথচলা। ক্লিকে ক্লিকে বঙ্গোপসাগরের যে বিবিধ
রতন তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেই অমূল্য সংগ্রহ আরও সমৃদ্ধ করতে চান, চান দেশের গর্বের এই সাগর দুনিয়ার অজানা গল্প বিশ্বের মানুষকে জানাতে।