গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই একসময় সাইকেল ব্যবহৃত হতো স্বল্প দূরত্বের বাহন হিসেবে। কিন্তু এই একুশ শতকে সাইকেল শুধু স্বল্প দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার বাহনই নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাহনও বটে। শহরগুলোয় বাহন হিসেবে নয়, বরং এখন স্বাস্থ্য রক্ষা এবং স্টান্ট করার জন্য সাইকেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা স্টান্ট নিয়ে কথা না বলে সাইকেল চালানোর স্বাস্থ্যগত সুবিধার কথা বলব আজ।
স্বাস্থ্য এবং শারীরিক দক্ষতা বাড়াতে সাইক্লিং
সাইকেল চালনার সময় আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ মাংসপেশিগুলো বিভিন্ন মাত্রায় কাজে অংশগ্রহণ করে। ফলে, পেশির গঠন দৃঢ় হয়। অন্য অনেক খেলাধুলার তুলনায় সাইক্লিংয়ে তেমন কোনো শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ মানুষ সাইকেল চালাতে জানে এবং একবার শিখে ফেললে কেউ তা ভোলে না। আবার সাইকেল চালানো বারবার অনুশীলন করে আয়ত্ত করতে হয় না। তাই এটি অন্য অনেক ব্যায়াম বা শারীরিক অনুশীলনের চেয়ে সহজ। সাইক্লিং স্বাস্থ্যের গঠন ঠিক রাখে, শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমতে দেয় না এবং শারীরিক কার্যক্ষমতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া নিয়মিত সাইকেল চালানোর ফলে পথ এবং শারীরিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার কারণে মানুষের ধৈর্যশক্তি বেড়ে যায়।
আবার দীর্ঘদিনের অসুস্থতা কিংবা আঘাত থেকে সেরে উঠে স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থা ফিরে পেতে সাইক্লিং একটি চমৎকার উপায় হতে পারে। স্বল্প শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে দৈনন্দিন অল্প অল্প সাইক্লিং পুনরায় স্বাভাবিক শারীরিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বর্তমানে সাইক্লিংয়ের অনেক প্রতিযোগিতা এবং স্টান্ট শুরু হয়েছে, সেগুলোতে অংশগ্রহণ একই সঙ্গে আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখবে। এ ছাড়া সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে ভ্রমণের পাশাপাশি পৃথিবীব্যাপী অনেক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যেগুলো একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসচেতনতার পাশাপাশি অবসর বিনোদনের চমৎকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিনের অনেক প্রয়োজন এবং স্বল্প পরিসরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবহনের চেয়ে সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে কম সময়ে এবং অর্থ ব্যয় না করেই তা সম্পন্ন করা যায়। বিশেষ করে যানজটের নগরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সাইক্লিং একটি চমৎকার মাধ্যম হতে পারে।
নিয়মিত সাইক্লিংয়ের স্বাস্থ্যসুবিধা
সাইক্লিংয়ের সময় একই সঙ্গে হৃৎপিণ্ড, শিরা ও ফুসফুস কাজ করে। এ সময় গভীর শ্বাস–প্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির অভিজ্ঞতা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করে। নিয়মিত সাইকেল চালালে—
১. হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়
২. শরীরের চর্বির মাত্রা হ্রাস পায়
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
৪. মানসিক উদ্বেগ ও বিষণ্নতা হ্রাস পায়
৫. পেশিশক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায়
৬. অস্থিসন্ধির গতিশীলতার উন্নয়ন হয়
৭. উন্নত অঙ্গবিন্যাস ও তার সমন্বয় সাধিত হয়
৮. হাড় মজবুত হয়।
স্থূলতা ও ওজন নিয়ন্ত্রণ
সাইক্লিং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ বা হ্রাস করার একটি ভালো মাধ্যম। কারণ এটি হজমশক্তি এবং খাবারের রুচি বাড়ায়, পেশি গঠন করে এবং শরীরের চর্বি পোড়ায়। সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি একটি স্বাস্থ্যকর পরিকল্পিত খাদ্যাভ্যাস যেকারও ওজন কমাতে সহযোগিতা করবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি সেটির পরিমাণ বাড়ালে তা যেকারও জন্য উপকারী হতে পারে।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যমে অন্তত প্রায় দুই হাজার ক্যালরি পোড়ানো যায়। তবে একেবারে নিম্নগতির সাইক্লিংয়ে এর হার প্রায় ৩০০ ক্যালরি। ব্রিটিশ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৩০ মিনিট সাইক্লিংয়ের ফলে একজন ব্যক্তির বছরে প্রায় পাঁচ কিলোগ্রাম চর্বি পুড়ে যায়।
কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং সাইক্লিং
নিয়মিত সাইক্লিংয়ের ফলে ফুসফুসসহ পুরো শরীরে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। ফলে, বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার রোগ, যেমন, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি আশঙ্কা কমে যায়। এ ছাড়া সাইক্লিং হৃৎপেশিকে শক্তিশালী করে এবং রক্তের চর্বির মাত্রা হ্রাস করে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাড়িতে চড়া লোকজনের চেয়ে যারা নিয়মিত সাইক্লিং করে কর্মক্ষেত্রে যায় অথবা দৈনন্দিন দুই থেকে তিনবার সাইক্লিং করে, তাদের ফুসফুস দীর্ঘদিন পর্যন্ত সচল ও কার্যক্ষম থাকে। ২০ থেকে ৯৩ বছর বয়সী ৩০ হাজার ব্যক্তিকে নিয়ে ১৪ বছর ধরে পরিচালিত একটি ড্যানিশ গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত সাইক্লিং মানুষকে হৃদ্রোগ থেকে রক্ষা করে।
ক্যানসার এবং সাইক্লিং
অনেক গবেষক ক্যানসারের কারণ হিসেবে নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করার অনীহার কথা বলেছেন। বিশেষ করে শারীরিক অনুশীলনের অভাবে কোলন ক্যানসার এবং স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি রয়েছে বলে জানা গেছে বিভিন্ন গবেষণায়। দেখা গেছে, সাইক্লিংয়ের কারণে অন্ত্রের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আবার কিছু কিছু গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয় যে নিয়মিত সাইক্লিং স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
ডায়াবেটিস এবং সাইক্লিং
বর্তমানে সারা বিশ্বে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে চলছে। শারীরিক অনুশীলনের অভাবে তা হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। ফিনল্যান্ডের একটি বড় গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে সাইক্লিং করা লোকের ৪০ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
হাড়ের আঘাত, আর্থ্রাইটিস এবং সাইক্লিং
সাইক্লিং শারীরিক অঙ্গবিন্যাস, কার্যক্ষমতা ও ভারসাম্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং হাড়ের ফাটল ও ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। যদি কারও অস্টিওআর্থ্রাইটিস থাকে তবে দৈনন্দিন অনুশীলনের জন্য সাইক্লিং একটি আদর্শ মাধ্যম হতে পারে। কারণ, এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ–প্রত্যঙ্গে খুব কম চাপ পড়ে।
মানসিক অসুস্থতা এবং সাইক্লিং
মানসিক অসুস্থতা, যেমন: বিষণ্নতা, চাপ ও উদ্বেগ নিয়মিত সাইকেল চালানোর মাধ্যমে হ্রাস করা যেতে পারে। সাইক্লিংয়ের আনন্দ ও মজা যেকাউকে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে।
কাজেই আর দেরি না করে একটি সাইকেল কিনে ফেলুন এবং নিরাপদ কোনো রাস্তায় নিয়ম করে পছন্দসই সময়ে সাইক্লিং শুরু করুন।
তথ্য ঋণ: বেটার হেলথ
ম্যাগডিলিনা মৃ: নারী সাইক্লিস্ট