ঘুটঘটে অন্ধকার। চারদিক সুনসান। গাছপালায় ছাওয়া গ্রামীণ পরিবেশ। মাঝরাত প্রায়। বেশির ভাগ বাড়ির বাতি নিভে গেছে। এক পাশে বাড়িঘর। অন্য পাশে নদী। মাঝবরাবর চলে গেছে পাকা রাস্তাটা। সেই রাস্তা ধরে সাইকেলের আলো ফেলে এগিয়ে চলেছি আমরা। টুংটাং না করে, ভেপু না বাজিয়ে চলতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বাধ্য ছেলের মতো এগোচ্ছে সবাই। দু–একজনের কথা কানে আসছে যদিও। কিন্তু সে শব্দ রাতের স্তব্ধতাকে কিছুতেই ভাঙছে না। ভাঙাচোরা রাস্তায় সাইকেলের টায়ার ঘষার আওয়াজ। দিনের বেলা এই শব্দ হয়তো কানেই আসত না। ‘রাতের অন্ধকারে সাইকেল চালানোর মজাই আলাদা’, পাশ থেকে বলল কেউ একজন। সেই মজা নিতেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের দক্ষিণ প্লাজা থেকে যাত্রা করেছিলাম জনা চল্লিশেক। প্রতি মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার রাতে এমনই নাইট রাইডের আয়োজন করে সাইক্লিং সংগঠন বিডিসাইক্লিস্টস (বিডিসি)।
বাঙালির যদি বারো মাসে তেরো পার্বণ থেকে থাকে, ১ লাখ ২৭ হাজার সদস্যের এই সংগঠনটিরও বছরজুড়ে নানা আয়োজন লেগেই থাকে। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার থাকে ‘বাইক ফ্রাইডে’। সেই ভোরে বিহানে একদল ছেলেমেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ঢাকার আশপাশের গ্রামগঞ্জ চষে বেড়ান। একসঙ্গে নাশতা করেন, জম্পেশ
আড্ডা দিয়ে তবেই বাড়ি ফেরেন। শনিবার ভোরে থাকে ‘জশিলা স্যাটারডে’। একটু দ্রুত যাঁরা চালান, তাঁদের জন্য এ আয়োজন। ঢাকা থেকে স্বল্প দূরের জায়গাগুলোতে ঘুরতে যান তাঁরা। এ দলে সাইক্লিস্টদের সংখ্যা একটু কম থাকেন। শনিবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্ট্রাইকার ফিল্ডে থাকে ব্যতিক্রমী আরেক আয়োজন। নবীনদের সাইকেল চালানো শেখানো হয় সেখানে। নারী ও শিশুরাই বেশি আসে বিডিসির ‘বিগানারস লেসনে’।
এর বাইরেও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস রাইড, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস রাইডের মতো বড়সড় আয়োজন প্রতিবছরই করা হয়। বড় এই রাইডগুলোতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে কয়েক হাজার সাইক্লিস্ট সমবেত হন। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পয়লা বৈশাখেও বর্ণিল রাইডের আয়োজন থাকে। শুধু নিজেরাই আনন্দ–ফুর্তি করে না বিডিসির সদস্যরা। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে দুস্থ মানুষের পাশেও দাঁড়ায়। এমনি একটি রাইড হচ্ছে ঈদ মোবারক রাইড। ঈদের খুশি সবার মধ্যে ভাগ কর দিতে সেই ভোরে রাস্তায় নামেন সাইক্লিস্টরা। বস্তি বা রাস্তার পাশের ছিন্নমূল মানুষ ও শিশুদের মধ্যে লাচ্ছা সেমাই, চকলেট, খেলনা, কাপড়চোপড় বিতরণ করেন। আছে সিক্সটি ফোর গুড অ্যাক্টসের মতো আয়োজন। দলবল নিয়ে একটা জেলায় গিয়ে দুস্থদের সহায়তা করা হয়। কখনো গরু, কখনো রিকশা, সেলাই মেশিন দেওয়া হয়।
এত সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বিডিসির আছে শক্তিশালী এক কর্মী বাহিনী। তাঁরা নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পরিচয় দেন। এ রকম স্বেচ্ছাসেবক আছেন ৩৭ জন, মডারেটর ৯ এবং অ্যাডমিন আছেন ২ জন, জানালেন বিডিসির স্বেচ্ছাসেবক মির্জা সামস। এই স্বেচ্ছাসেবীরা প্রায় অসাধ্যসাধনেও পটু। বছর তিনেক আগে ২০১৬ সালের বিজয় দিবসে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখায় বিডিসাইক্লিস্টস। একসারিতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ (১১৮৬ জন) একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে।
২০১১ সালের মে মাসে সংগঠনটির যাত্রা শুরু। মোজাম্মেল হক তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে বিডিসি গড়ে তোলেন। শুরুতে নিজেদের জন্য। ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো লোক বাড়তে থাকল। তখনো দলবলে সাইকেল নিয়ে রাইডে যেতেন তাঁরা। অনেকে অফিসে যেতে–আসতেও গাড়ি ছেড়ে সাইকেল ধরলেন। আস্তে–ধীরে লোকজন আরও বাড়তে লাগল। গত কয়েক বছরে ঢাকায় খুব নীরবে সাইকেল নিয়ে রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটে গেল। বহু মানুষ সময় আর স্বাস্থ্য বাঁচাতে বিডিসাইক্লিস্টসের দেখানো পথ ধরল। শুধু ঢাকায় নয়, নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাইক্লিংয়ের এই জোয়ার এখন সারা দেশে বইছে। বিভিন্ন জেলা শহরে বিডিসাইক্লিস্টসের আদলে গড়ে উঠেছে সাইক্লিংয়ের নানা সংগঠন।