>বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখনো সবার মনে দগদগে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে যখন ফুঁসছিলেন আন্দোলনকারীরা, তখনই বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিভিন্ন দেয়ালে দেখা মিলল গ্রাফিতির। দেয়ালে দেয়ালে ঝরে পড়ল সময়ের ক্ষোভ। তবে রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনে গ্রাফিতির চর্চা অনেক দিনের। কিছুদিন আগেই নাড়া দিয়ে গেছে ‘সুবোধ’। গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র নিয়েই এই প্রতিবেদন।
গল্পটা পশ্চিমের কোনো শহরের। সোমবার সকালে অফিস যাওয়ার সময় জন রিডল খেয়াল করলেন, তাঁর বাড়ির সামনের দেয়ালের এক কোনায় নানা রঙের আঁকিবুঁকি। কেউ চুপিসারে পরিচয় গোপন করে এমন কাণ্ড করে চলে গেছে। মনোযোগ দিয়ে দেখারও সময় পেলেন না বেচারা, পাছে অফিসের দেরি হয়ে যায়। সাবওয়ে ট্রেন থেকে নেমে মিনিট দু–এক হেঁটে অফিস ভবনে ঢুকতে হয় তাঁকে। অফিসের একটু আগেই দেখলেন, একটি পুরোনো বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, নতুন বাণিজ্যিক ভবন বানানো হবে বলে। সেই ভাঙা দেয়ালে নানা লেখাজোখা আগেও তাঁর চোখে পড়েছে। আরে একি! বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দেখা ছবিটা এখানেও। হুবহু একই। একই রং। গত শুক্রবারও তো চোখে পড়েনি ব্যাপারটা।
সপ্তাহজুড়ে নানান জায়গায় এ রকম কর্মকাণ্ড জনের চোখে পড়তে লাগল। রাস্তার পাশের সীমানাপ্রাচীরে, কারও ছাদের চিলেকোঠায়, সাবওয়ে ট্রেনের বগিতে, মালটানা গাড়ির শরীরজুড়ে, এমনকি বড় বড় সেতুর উঁচু লোহার কাঠামোগুলোও বাদ যায়নি। এত ওপরে এরা উঠল কী করে! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কী দুরন্ত, কী সাহস এদের, কারা এরা? দেখা যায় না, চেনা যায় না এদের। দেখতে দেখতে পুরো শহর রঙিন আঁকাআঁকি-লেখাজোখায় ভরে যেতে লাগল। এরই মধ্যে জনও জেনে গেলেন, এগুলো গ্রাফিতি। এই গ্রাফিতির একটু একটু প্রেমেও পড়ে গেলেন তিনি।
অবশ্য কদিনের মধ্যেই এই ভালোবাসা উবে গেল একদম। যেদিন জন রিডল হাতে পেলেন নগর পরিষদের চিঠিটি। আবাসিক প্রকল্পের সৌন্দর্য রক্ষার্থে তাঁর বাড়ির দেয়াল রং করার সুস্পষ্ট আদেশ দেওয়া আছে তাতে; অন্যথায় জরিমানা গুনতে হবে তাঁকে।
শুরু হলো দ্বান্দ্বিক অবস্থান। এই গল্পটা সত্তরের দশকের। কিন্তু এখনো চলছে একই দ্বন্দ্ব। গ্রাফিতি আর্ট নাকি ভ্যান্ডালিজম (ধ্বংস করার প্রবণতা)। এই তো সেদিনও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের এক সিটি কাউন্সিলর গ্রাফিতিশিল্পীদের গ্রাফিতি-ভ্যান্ডাল আখ্যা দিয়ে বললেন, ‘তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সেই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, যেখান থেকে আমার প্রপার্টি শুরু।’ আবার বিপরীত অবস্থানে থাকা কারও কারও বক্তব্য এমন—বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাওয়া শহরকে তারা পুনরুদ্ধার করছে।
তো, এই গ্রাফিতির ইতিহাস আসলে বহু পুরোনো। ইতিহাসেরও আগের। গুহাবাসীদের সময় থেকেই। এরপর মিসরীয় সভ্যতা, গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় গ্রাফিতির নানা নিদর্শন মেলে। কোথাও পশুর চর্বি মেশানো পাথরগুঁড়ার রং দিয়ে আঁকা, কোথাও খোদাইকর্ম, আবার কোথাও মোজাইক করা দেয়ালচিত্র।
আর হালের গ্রাফিতি সংস্কৃতির শুরু ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। তবে তার পাশের রাজ্য নিউইয়র্কে এসে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় গ্রাফিতি। বিশেষ করে হিপহপ চর্চাকারীদের কাছে। আর বেশ দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীজুড়ে।
বর্তমানে এ দেশেও গ্রাফিতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কেবল। যদিও এ অঞ্চলের মানুষের দেয়ালে আঁকার স্বভাব বেশ পুরোনো। বিশেষ করে সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে নিজেদের মাটির ঘরের দেয়ালে রঙিন মাটির চিত্রণ মনোমুগ্ধকর। পাড়াজুড়ে প্রতিটি বাড়িই ফুল-লতা-পাতা আর নানা পশুপাখির নানা মোটিফে চিত্রিত। সাঁওতালদের আঁকাআঁকির এই সংস্কৃতি তাদের নিয়মিত সৌন্দর্যচর্চারই অংশ।
রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভিন্ন আন্দোলনের সময়ও এ দেশে দেয়ালে দেয়ালে ক্ষোভ ঝরে পড়ত। ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলনের সময় এই চর্চা বিশেষ শক্তি জুগিয়েছিল। হাতে আঁকা পোস্টার আর ফেস্টুন-ব্যানার ছাড়া মিছিলগুলো কল্পনা করা যায় না। প্রতিবাদী কত কার্টুন আর কত প্রতিবাদী পঙ্ক্তিমালার জন্ম হয়েছে তখন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সব আন্দোলনে আর ১৯৭১–এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে দেয়ালচিত্রণ।
স্বাধীনতার পর একই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটা বড় অংশজুড়ে ছিল দেয়াললিখন। হয়তো কোনো প্রতিবাদী কবিতার লাইনের সঙ্গে শৃঙ্খলিত মুষ্টিবদ্ধ হাত কিংবা বুটের নিচে কোনো ছাত্রের থেঁতলে যাওয়া মাথা আঁকা থাকত সে দেয়ালচিত্রে। কখনো আঁকা হতো শহীদ সহযোদ্ধার মুখ, যাঁকে স্মরণ করে আন্দোলন আরও জোরদার হতো।
বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার দেয়াল ছেয়ে গিয়েছিল কয়েকটি শব্দ দিয়ে। ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’—এই চিত্র মনে করিয়ে দেয় সত্তরের দশকের নিউইয়র্কের সেই অলিগলি ছেয়ে যাওয়া গ্রাফিতি ‘TAKI 183’–এর কথা। এই আইজুদ্দিনকে আমরা চিনি না। জানা যায়নি তার পরিচয়। পরবর্তীকালে আমরা নিউইয়র্কের সেই বালককে চিনে গিয়েছি, যার নাম দিমেত্রাকি আর ১৮৩ ছিল তার ফ্ল্যাটের নম্বর। সেভাবে হয়তো আমরাও আইজুদ্দিনকে চিনে নেব একদিন।
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’—প্যান্ট পরা খালি গায়ে শ্মশ্রুমণ্ডিত হাল ছাড়া ভঙ্গিতে বসে আছে এক যুবক। পাশে খাঁচাবন্দী সূর্য। অস্থির সময়ে আশাহত জনতার বিলাপ। দেয়ালে স্টেনসিল পদ্ধতিতে ছাপ দেওয়া। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালগুলোতে এখনো এ রকম ছবি চোখে পড়ছে। আঁকার ধরন হালের বিখ্যাত গ্রাফিতিশিল্পী ব্যাংকসির মতো। ইংল্যান্ডের এই ব্যাংকসিরও শুধু নামটি আমরা জানি। আর কোনো পরিচয় জানি না। যেমন জানি না ‘সুবোধ’ সিরিজের শিল্পীকে।
চলমান সময়ে আবরার হত্যাকাণ্ডে বুয়েট শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে। বিচারের দাবিতে ফুঁসছিলেন আন্দোলনকারীরা। তখনই আবার শুরু গ্রাফিতির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সেখানকার দেয়ালগুলো ছেয়ে গেছে আঁকা-লেখায়। স্টেনসিল, স্প্রে ক্যান আর অক্সাইড রঙে আঁকা হয়েছে দেয়ালগুলোতে। চিত্রগুলো আশি আর নব্বইয়ের দশকের মতোই আঁকা। চোখবাঁধা মানুষের মুখ, বুটের তলায় পিষ্ট জনতা। আর আছে আবরারের প্রতিকৃতি। সেখানে হয়তো আবরার বলতে চাইছে—বন্ধুরা, রক্ষা কোরো তোমাদের প্রিয় প্রাঙ্গণ, আর কারও যেন এমন পরিণতি না হয়…।
লেখক: চিত্রশিল্পী ও সংগীতশিল্পী