টাইম সাময়িকীর করা বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের মেরিনা তাবাশ্যুম। স্থাপত্যে প্রচলিত ঘরানার বাইরের কাজের জন্য তাঁর একটা আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে আগেই। ঢাকার দক্ষিণখানের সায়েদাবাদে তাঁর নকশা ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত বায়তুর রউফ মসজিদের জন্য ২০১৬ সালে জিতে নিয়েছেন স্থাপত্যের সম্মানজনক পুরস্কার আগা খান পুরস্কার। ২০১৮ সালে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট জাদুঘর আয়োজিত জামিল প্রাইজ। ২০২০ সালের ১৪ জুলাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী প্রসপেক্ট তাঁকে বিশ্বের ৫০ জন চিন্তাবিদের তালিকায় স্থান দিয়েছে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক হয়ে আরবানা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মেরিনা। আরবানার মাধ্যমেই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের কাজটি করা হয়েছে। ২০২০ সালে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান। সেই সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করা হলো
মুনির হাসান: আলোচনাটা শুরু হোক বায়তুর রউফ মসজিদ দিয়ে। আপনি মসজিদের দুই পাশে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
মেরিনা তাবাশ্যুম: আপনি বলতে পারেন এটা মান আর পরিমাণের দ্বন্দ। সাধারণত জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ বা রমজান মাসের তারাবির নামাজের সময় মানুষের সমাগম বেশি হয় মসজিদে। বাকি দিনগুলোতে কিন্তু তিন কাতারের বেশি মানুষ হয় না। তো এইখানে জায়গাটাকে না ঘিরে সেটা ছেড়ে দিলে মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে। সামাজিকভাবে যোগাযোগ করতে পারে। আমার মনে হয় এটা খুবই প্রাণবন্ত একটা জায়গা মানুষের ব্যবহারের জন্য।
মুনির: মসজিদে বিরাট একটা হলরুম—যার মাঝখানে কোনো পিলার নেই এবং আপনি সেখানে বৃষ্টি পড়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এই মসজিদের স্থাপত্য নকশা করার সময় কী বিষয় মাথায় রেখেছেন?
মেরিনা: আসলে অনেক ব্যাপার আছে এর মধ্যে। একটা হলো বড় একটা জায়গা। নকশা করার সময়ে প্রথমেই মাথায় ছিল যে ইসলামের একটা জরুরি শিক্ষা হলো মানুষ সবাই সমান, সমতায় বিশ্বাসী, ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী। তো মানুষ যখন একসঙ্গে হবে প্রার্থনার জন্য, তখন যেন কেউ অনুভব না করে যে সে আরেকজনের থেকে কম সুবিধা পাচ্ছে। যে কারণে আমার সব সময় মাথায় ছিল যে চারদিক থেকেই আলো আসবে এবং আমি যেখানেই দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ি না কেন আমি যেন আলোটা অনুভব করতে পারি। আর বাতাসের যে ধারা সেটা যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে পাই। তো এটা করেছিলাম ভ্রাতৃত্বের ব্যাপার চিন্তা করে। চারদিকে খোলা জায়গা, চারদিক থেকে বাতাস আসে।
মুনির: যখন একটা নতুন স্থাপত্য প্রকল্প শুরু করেন তখন কোন তিনটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেন?
মেরিনা: প্রথমত হচ্ছে কোথায় বানাচ্ছি, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোথায় যখন বলব তখন অনেক প্রশ্ন চলে আসে। যেখানে বানাচ্ছি সেখানকার ভৌগলিক গঠন, আবহাওয়া, পারিপার্শ্বিকতা, সংস্কৃতি, সেই স্থানের ব্যবহারযোগ্য উপাদান—এই সবকিছু মিলিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আসে। তারপর যে প্রশ্ন আসে সেটা হলো কী বানাতে চাচ্ছি? মানে হলো প্রয়োজনগুলো কী, কার্যক্রম কী। তৃতীয় প্রশ্নটা হলো কার জন্য ও কীভাবে।
মুনির: আপনার জীবনের সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ আপনি কোনটাকে বলবেন? টাকা, শ্রম, সময় এগুলো বিবেচনা করে।
মেরিনা: প্রথম বিনিয়োগের কথাই বলি। আমি যখন অফিস করলাম, আমার খালা–খালু তখন বাড়ি বানাচ্ছিলেন গুলশানে। তখন বললাম, আমি নকশা করে দেব আর একটাই শর্ত কোনো ফি নেব না। কিন্তু আমি যেভাবে নকশা করতে চাচ্ছি সেটা সম্পূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। তাঁরা তাতে রাজি হয়ে যান। আমার নকশা অনুযায়ীই সেই বাড়ি বানান। কিন্তু এটা আমার পক্ষ থেকে একটা বিনিয়োগ ছিল। কারণ, তাতে আমার একটা পোর্টফোলিও তৈরি হলো, কাজ বাড়লো এবং যে কাজটা আমাকে আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার ‘আর্কিটেক্ট অফ দ্য ইয়ার’ এনে দিল। এটা ভারতের জেকে সিমেন্ট থেকে পরিচালিত হয়। আমি মনে করি, যখন পোর্টফোলিও থাকে না তখন এ ধরনের কাজ করে আমাদের নিজের পোর্টফোলিও তৈরি করতে হয়। তো সেটাই আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ।
মুনির: আপনি তো পড়ানোর সঙ্গেও আছেন। বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ডিরেক্টর। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ২০০৫ সাল থেকে। এখন যাঁরা পড়তে আসেন, তাঁদের সঙ্গে আপনার ছাত্রজীবনের যদি তুলনা করেন, তবে এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের কোন বিষয়টা আপনাকে ভাবায়?
মেরিনা: দেশে ও বিদেশেও পড়িয়েছি। আমার মনে হয় যে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা কিন্তু কোনো অংশে কম না। তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সৃজনশীল ও চটপটে। তো তার কারণে আমি দেশে বা বিদেশে আলাদাভাবে কিছু পাইনি। আমি আসলে কখনো কোনো সমস্যা পাইনি। ছাত্র–ছাত্রীরা তো নানা ধরনের চিন্তাভাবনা নিয়ে আসে এবং আমি সেসবে অংশ নিতে পারছি, এই ব্যাপারটা আমার জন্য খুব ফলপ্রসু।
মুনির: আমাদের দেশে প্রতিবছর ২২ লাখের মতো ছেলেমেয়ে কর্মজীবনে আসেন। সবাই জীবনে উন্নতি করতে চান। তাঁদের জন্য আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
মেরিনা: খুবই জরুরি একটা বিষয় হলো সময়টাকে বোঝা, সময়ের প্রয়োজন বোঝা এবং সেটির ভিত্তিতে সময়োপযোগী একটা সমাধান বের করা। আমরা একটা দৃষ্টান্তমূলক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তো এই সময়কে বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো হবে।
মুনির: নতুন স্থপতিদের জন্য কোনো পরামর্শ? আর আপনি যখন পাশ করে বের হয়েছেন তখন তো অনেক পরামর্শ শুনেছেন। কোনগুলো আপনার কাজে লাগেনি?
মেরিনা: আমরা পড়া শেষ করে যখন চর্চা করতে এলাম, তখন দেখলাম বাস্তব দৃশ্যটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা পড়ালেখা করছিলাম তার থেকে অনেক আলাদা। সেখানে একটা তো ধাক্কা থাকেই। ওই ধাক্কা বোঝার পর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি কীভাবে এগোতে চান। আপনি অন্যান্য ফার্মগুলোর মতো গৎবাঁধা পদ্ধতিতে এগোতে পারেন অথবা চিন্তা করতে পারেন আগামী ১০–২০ বছরে আপনি নিজেকে কোথায় দেখতে চান। আপনার বিশ্বাসের জায়গাটা কোথায়, আপনি কীভাবে চর্চা করতে চাচ্ছেন। আমি তো সব সময় তরুণ স্থপতিকে বলি, একটা দেশে যেখানে ৯৯ শতাংশ মানুষের আমাদের ফি দেয়ার সামর্থ্য নেই, সেই দেশে কীভাবে স্থাপত্যচর্চা করব—তার নতুন ধারা তৈরি হওয়া উচিত। আর আমি মনে করি, তোমরা সেই ধারা খুঁজে বের করবে।
মুনির: আমি যেটা বুঝতে পারলাম, আপনি সব সময় একটা পদ্ধতির মধ্যে থাকেন। ধরুন, এর বাইরে একটা কাজ করতে গিয়ে তার কোনো নিশানা পাচ্ছেন না, মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তখন কীভাবে কাজে ফিরে আসেন?
মেরিনা: আমি খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারি, বলতে পারেন এটা আমি চর্চা করে তৈরি করেছি। এটা আগে ছিল না। যখন তরুণ ছিলাম, তখন নানা রকমের দ্বিধা–দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন খুব পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারি এবং ভাবনার কেন্দ্রটা কখনো হারাই না।