অভিজ্ঞতা

সব শিক্ষকই যদি এমন হতেন!

>
পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব। ছবি: সংগৃহীত
পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে অভিভাবক দিবস মানে যেন ঈদের মতো আনন্দ। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের শুক্রবারের মতো ৮ ফেব্রুয়ারিও ছিল এমনই এক অভিভাবক দিবস। সেদিনও ক্যাফেটেরিয়ায় এক কোণে ছেলের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন মা, কোনো এক বাবা তাঁর মেয়ের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন, কেন মেয়ের মাকে সঙ্গে আনতে পারেননি। এরই মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন পাঁচ মেয়ের বাবা প্রভাষ রঞ্জন দেব। তবে এই মেয়েদের জনক নন তিনি।

‘মা, আরেক টুকরো মাংস নাও তো।’ দাঁড়িয়ে আদুরে গলায় এক এক করে পাতে তুলে দিচ্ছেন মাংস। সকালের নরম রোদে চেয়ারে বসে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে যাচ্ছে পাঁচ মেয়ে। বাড়ি থেকে আনা পছন্দের খাবার মেয়েদের পাতে তুলে দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে তাদের খেতে দেখতে পারার মধ্যেই যেন মানুষটির সব সুখ। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দার কোনাটা তখন বাবা-মেয়েদের ভালোবাসার সুরভিতে ম–ম করছে। চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে পাশের গোলাপ ফুলের বাগান থেকে আসা সুবাসের চেয়েও সুগন্ধি।

প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী প্যারেন্টস ডে বা অভিভাবক দিবসে দৃশ্যটির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন সেখানকার শিক্ষকেরা। কিন্তু সেখানে উপস্থিত থাকা অনেক আগন্তুকের মনেই কৌতূহল, প্রায় সমবয়সী পাঁচজনই কি একজনের মেয়ে?

খাবার শেষ হওয়ার পর এগিয়ে গিয়ে গল্প শুরু করে দিতেই আশ্চর্যের পারদটা আরও বেড়ে গেল। হ্যাঁ, পাঁচজনই প্রভাষ রঞ্জন দেবের মেয়ে। তবে কারও জনক তিনি নন। মানুষটার যে বিয়ের পিঁড়িতেই বসা হয়নি। তিনি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই ৪২ বছর বয়সী এই মানুষের সন্তান। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে গেলেন, ‘পাঁচজনই আমার মেয়ে। আমার সন্তান আছে আরও অনেক।’

সাধারণত প্রধান শিক্ষকের মূল কাজ স্কুলের পড়াশোনা তদারক করা। প্রভাষ রঞ্জন দেব ভালোভাবে তা করতে পেরেছেন বলেই শেষ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় তাঁর স্কুলে শতভাগ কৃতকার্য।

প্রধান শিক্ষক হয়েও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মা–বাবাকে বুঝিয়ে মেয়েদের খেলার মাঠে এনেছেন প্রভাষ রঞ্জন দেব। উঠান আকৃতির স্কুলমাঠে সারা বছর দিয়ে যাচ্ছেন ফুটবল প্রশিক্ষণ। সঙ্গে সহকারী প্রশিক্ষক হিসেবে আছেন একই স্কুলের শিক্ষক সহিদুল ইসলাম। কারোরই ফুটবল প্রশিক্ষণের ওপর নেই কোনো সনদ। ছোটবেলায় খেলার সুবাদে যা জানেন, তার সঙ্গে আবেগ ও ভালোবাসা পুঁজি করে যাচ্ছেন এগিয়ে। ‘ঠিকমতো খাবার পায় না, আবার মেয়ে খেলব ফুটবল’ কথাটি অনেকবার শুনতে হয়েছিল প্রভাষ রঞ্জনকে। থেমে যাননি বলেই মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজছে এখন নারী জাগরণের গান।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের নারী ফুটবলে বড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ স্কুল ফুটবল। সে আলোর রোশনাই পড়েছে গ্রামের প্রত্যন্ত স্কুলটিতে। প্রাথমিক স্কুলের টুর্নামেন্টটিতে ভালো খেলার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সাল থেকে গোয়ালদহে শুরু হয় ফুটবল মিশন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগে হয় টানা রানার্সআপ। গত বছরে ভেঙেছে সেই শিরোপার শিকল, প্রথমবারের মতো হয়েছে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন। আসন্ন ঢাকার মূল পর্বে এবার গোয়ালদহের সৌরভ ছড়ানোর পালা। প্রায় ছয় বছর আগে স্কুলে যে ফুটবলের বীজ বুনেছিলেন প্রভাষ রঞ্জন, আজ তা বড় গাছ হয়ে ওঠার মতো।

স্কুল থেকে সদ্য পাস করে বের হওয়া আনিকা তানজুম, রিয়া খাতুন, পূর্ণিমা রানী, সুবর্ণা খাতুন ও সাথি বিশ্বাস জায়গা করে নিয়েছে বিকেএসপিতে। ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন বছরের ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় মেয়াদে উত্তীর্ণ হয়েছে আরও তেরোজন। বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যৎ বিকেএসপির নারী দলের একাদশের গায়ে জলছাপ থাকবে ‘গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।

আলোর মশাল হাতে

প্রধান শিক্ষকের দিকনির্দেশনায় গোয়ালদহে যে আলোর মশাল জ্বলছে, তাতে পথ দেখতে পারে অনেক স্কুলই। পড়াশোনা ও খেলাধুলা ছাড়াও সব ভালোতেই সরব বিচরণ। ২০১৫ সালে দেশাত্মবোধক গান ও দলীয় নৃত্যতে বিভাগীয় পর্যায়ে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন, ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত নাট্য প্রতিযোগিতায় জেলা চ্যাম্পিয়ন। স্বাভাবিকভাবে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথা পৌঁছে যায় জেলা সদর দপ্তরে। স্বীকৃতিস্বরূপ টানা দুবার জেলার সেরা শিক্ষকের মুকুট উঠেছে তাঁর মাথায়। এভাবে নিজের দায়িত্বগুলো আরও সুন্দরভাবে পালন করতে পারলে তিনিই তো হতে পারেন দেশের মডেল প্রধান শিক্ষক, যেমন শিক্ষক আমরা চাই, ‘আমি সেদিনই ভালো প্রধান শিক্ষক হতে পারব—যেদিন অত্র বিদ্যালয়ের অর্ধেক পরীক্ষার্থী জিপিএ–৫ পাবে, বঙ্গমাতা ফুটবলে আমার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হবে, মহিলা জাতীয় দলের অর্ধেক ফুটবলার হবে আমার স্কুলের, বিকেএসপির অর্ধেক মেয়ে ফুটবলার হবে আমার। আর মেয়েদের হাত ধরে তাদের পরিবার হবে সমৃদ্ধ।’ মেয়েদের সামনে রেখে কথাগুলো একদমে বলে যান প্রভাষ রঞ্জন।

অভিভাবক দিবস উপলক্ষে মাগুরা থেকে আগের রাতে রওনা দিয়ে প্রভাষ রঞ্জনের সঙ্গে এসেছিলেন অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এক ছাত্রীর বাবা ও মা। বিকেএসপিপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে মায়ের খুব গর্ব। সেই গর্বের পেছনের নায়কের আসনে বসিয়ে দিলেন গ্রামের স্কুলমাস্টারকে, ‘আমার মেয়ে এবার দিল্লির সুব্রত কাপে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ক্লাসেও হয়েছে প্রথম। ক্লাস ফাইভে বৃত্তিও পেয়েছিল। নাচতে পারে, গাইতে পারে। সবই সম্ভব হয়েছে ওই (আঙুল ইশারা করে) মানুষটার জন্য। অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে আমাদের স্কুলের পার্থক্য ওই একজনই। তাঁর সবকিছুই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। ওরা কবে ছুটিতে যাবে, ছুটি শেষে ঢাকা আসবে—সব চিন্তাই তাঁর। ওরা বাড়িতে গিয়ে ঠিকমতো পড়াশোনা করছে কি না, প্র্যাকটিস করছে কি না—নিচ্ছেন সে খবরও। প্রয়োজনে কয়েক বেলা প্রাইভেট পর্যন্তও পড়ান। কিন্তু কোনো টাকাও কোনো দিন আমাদের দিতে হয়নি। পৃথিবীর কোনো শিক্ষক ছেলেমেয়েদের প্রতি এত সময় ব্যয় করেন না।’

এক মায়ের কথা শুনতে শুনতে ফিরে গেলাম স্কুলজীবনে। রচনায় পড়েছিলাম একজন আদর্শ শিক্ষকের কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন। সেই গুণগুলো মেলানোর চেষ্টা করলাম অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেবের সঙ্গে। মন বলল, দেশের প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকই যদি এমন হতেন!