‘সে অনেক কাল আগের কথা। সব্যসাচী হাজরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রাঙ্কন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। চারুকলার বারান্দায় বড় একটি ব্যানার টাঙানো হয়েছে। ব্যানার যতটা না ব্যানার, তার চেয়ে বেশি আর্টওয়ার্ক। তখন তো কম্পিউটারের জারিজুরি ছিল না। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমি আর আমার এক বন্ধু হাঁ করে ব্যানার দেখছি। কখন যেন আমাদের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য পেছনে এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যানারটা কে করেছে রে?
আমি বললাম, সব্য।
শিশির ভট্টাচার্য মাথা নেড়ে বললেন, হুম, ছেলেটা বাজে।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম, ‘বাজে’ না ‘বাজে’?
তো স্যার বললেন, ‘বাজালে বাজে, টোকা দিলেই বাজে।’
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে ঢুকতেই ‘জলের গানে’র ভোকাল রাহুল আনন্দের সঙ্গে চোখাচোখি। সেখানে চলছে শিল্পী সব্যসাচী হাজরার বাংলা হরফের বিবর্তনের ওপর প্রদর্শনী ‘ব্রাহ্মী টু বাংলা’। এ ছাড়া এই আয়োজনে সব্যসাচীর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘অ-ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি’ নামের বইটিও আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর মুখ দেখল। বাংলা হরফের জন্ম ও ক্রমবিকাশ নিয়ে লেখা বইটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছেন সব্যসাচী! রাহুল আনন্দের কাছে প্রদর্শনী কেমন লাগল, জানতে চাইলে ওপরের গল্প দিয়ে শুরু করলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমরা তো আজ সব্যকে সবাই চিনেছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষক অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন যে ওর ভেতরে কী ছাই চাপা আগুন আছে।’
বাংলা গানের এই শিল্পী আরও যোগ করলেন, ‘কাজটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর আর স্বাধীনতার ৫১ বছর কেটে গেল বর্ণমালাগুলো কোত্থেকে কীভাবে এল, সেই খোঁজ করতে। এর মাধ্যমে বর্ণমালা গবেষণার নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হলো। সব্যর এই শৈল্পিক সৃজনশীল অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। তাতে আমাদের সবার মঙ্গল। বাংলার মঙ্গল। বিশ্বের মঙ্গল।’
আয়োজনের শুরুতে সব্যসাচী হাজরা বলেছিলেন, তিনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। অনেক কিছু বলবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু উপস্থিত সবার সমানে মাইক্রোফোনে সব নাকি কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই কথার রেশ ধরে আরেক শিল্পী ও গুণী অভিনেতা আফজাল হোসেন বললেন, ‘আমি তো বুঝি না, সব্যর গুছিয়ে কথা বলার দরকারটা কী! ওর চুল আর দাঁড়িগুলো যেমন আছে, তেমনই থাক। ওর স্বাস্থ্যও এ রকম ভাঙাচোরা থাক। কেবল ওর চিন্তা আর কর্ম যেন গোছানো, গভীর হয়।’
ছাত্র সব্যসাচীর কাজ নিয়ে কথা বললেন অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য। একই মঞ্চে স্থপতি ও নির্মাতা এনামুল করিম নির্ঝর বললেন, ‘ছোটবেলায় পড়েছি “অ”য়ে অজগর ওই আসছে তেড়ে। পড়েই আমি বাবার কাছে দৌড়ে গেছি। জিজ্ঞাসা করেছি, বাবা অজগর শুধু শুধু কেন আমার দিকে তেড়ে আসবে? আমি কী করেছি?’ অতিথিদের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোমিনুল ইসলাম ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকার পরিচালক ফ্রঁসোয়া ব্রোজ।
লা গ্যালারি বিকেল পাঁচটার আগ থেকেই কানাই কানাই ভর্তি। সেটা যেন কয়েক ঘণ্টা জন্য পরিণত হয়েছিল চারুকলার নানা বর্ষের শিল্পীদের আনন্দমেলায়। অনেক দিন পর যেন একই পরিবারের অনেক সদস্যরা এক ছাদের নিচে। কুশল বিনিময়ের সঙ্গে চলছে শিল্প নিয়ে কথোপকথন। শিশুরাও এদিকে সেদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যেই দেখা হয়ে গেল সব্যসাচীর কন্যা পৌষের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম, বাবার প্রদর্শনী দেখে কেমন লাগছে? দৌড়াতে দৌড়াতেই উত্তর দিল, ‘অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু অনেক মানুষ।’
আসলেই অনেক মানুষ। যদিও আয়োজকদের একজন জানালেন, তুলনামূলকভাবে যাঁরা আরও বয়স্ক, সে রকম অন্তত ২০০ জনকে তাঁদের স্বাস্থ্য আর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে প্রথম দিনের আয়োজনে আসতে বিনীতভাবে নিষেধ করেছেন তাঁরা। আরেক শিল্পী কনক আদিত্য প্রদর্শনীর ব্যাপারে বললেন, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি সব্যসাচীর প্রতি বড্ড বায়াসড। আমার ওনার সব কাজ ভালো লাগে। তিনি যত প্রচ্ছদ করেন, সব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আমি ওনার কাজের অন্ধভক্ত। আমার মনে হয়, উনি যা-ই করেন, নিজের সেরাটা দিয়ে করেন। তাই ওই কাজটাও সম্ভাব্য যতভাবে হতে পারত, এর ভেতর সবচেয়ে সেরা ভার্সনটাই হয়ে ওঠে।’
প্রদর্শনীতে বিভিন্ন সময়ে যে বইগুলো বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, সেগুলোর প্রচ্ছদও ছিল। এই যেমন ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘হাসিখুশি’, ‘সহজপাঠ’, ‘হাতেখড়ি’ ইত্যাদি। তা ছাড়া প্রদর্শিত হয়েছে বাঁশ, কাঠ, বেত বা এ রকম প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি বেশ কিছু কলম। এগুলো সব্যসাচী হাজরা মহামারিকালজুড়ে বানিয়েছেন। আর কোন কলমে কেমন লেখে, তা পরীক্ষা করে দেখেছেন।
প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন ফ্রন্টে বাংলা চলচ্চিত্র, পত্রিকার সংবাদের শিরোনাম, রিকশা বা গাড়ির পেছনে যেসব লেখা থাকে, সেগুলোর নাম।
এ সবকিছুই আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারি ও তাঁর আশপাশের কথা। কিন্তু আমরা যদি সময়টাকে পিছিয়ে, স্থান বদলিয়ে, মঙ্গলবার সকালে সব্যসাচী হাজরার ধানমন্ডির বাড়িতে যাই, সেখানে দেখতে পাব একান্ত আবেগীয় এক দৃশ্য। হয়েছে কী, সব্যসাচী হাজরার মা–বাবা থাকেন খুলনা। তাঁদের এই ইট-পাথরের শহর টানে না। তাঁদের খুলনার ভিটেমাটি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, গিয়ে দুদণ্ড থাকতে ইচ্ছে করে না।
মা–বাবাকে ছাড়া নিজের এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর দিন সকালে সব্যসাচী হাজরার বাড়িতে হাজির হলেন আরেক শিল্পী, ডিজাইনার চন্দ্রশেখর সাহা। বিশেষ এই দিনে সব্যসাচীর পরে যাওয়ার জন্য গাঢ় শেওলারঙা একটি পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছেন তিনি। পাঞ্জাবি এই অনুষ্ঠানে পরার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা। তাই পছন্দ হলেও পাঞ্জাবির আর ‘দ্বিতীয় পিস’ নেই। সেই পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে শিল্পী সব্যসাচী হাজরার চোখ ভালোবাসার আর্দ্রতায় খানিকের জন্য সব অস্পষ্ট দেখতে লাগল। প্রদর্শনীর বিভিন্ন ছবিতে সব্যসাচীর গায়ে যে পাঞ্জাবি দেখতে পাচ্ছেন, সেটির কথাই বলছি।
প্রদর্শনী আর বই ছাড়াও এই দিনে নিজের করা বাংলা টাইপফেস ‘সব্যসাচী’ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন সব্যসাচী। আসকি ও ইউনিকোড—দুই ভার্সনেই যে কেউ চাইলে ফ্রি ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারবে।
একটা প্রশ্ন করি। আচ্ছা বলুন তো, ‘অ’ একেবারে শুরুতে দেখতে কেমন ছিল?
ইংরেজি বর্ণ উল্টো ‘কে’ এর মতো!
সেখান থেকে কীভাবে আজকের এই রূপ নিল, জানতে হলে আপনাকে প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখতে হবে। ১২ দিনের এই প্রদর্শনী চলবে ২৫ জুন পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে লা গ্যালারির দুয়ার।