বাড়িটির যেকোনো ঘরে বসলে মনে হয় বাইরেই বসে আছি। প্রকৃতি যেন ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর বাতাস, আলো–ছায়াকে সঙ্গী করে। বাড়িটির নাম ‘সবুজ পাতা’। এই বাড়ি এ বছরের আর্কেশিয়া অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার নামের আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। সবুজ পাতার অন্দর-বাহির থাকছে এই প্রতিবেদনে
রাস্তা থেকে তাকালে বাড়ির অস্তিত্ব বোঝা ভার। বরং মনে হবে ৩০-৩৫ ফুট উঁচু গাছ, লতাগুল্মের স্তূপ কিংবা ছোট টিলা। সবুজও বেশ গাঢ়। দুপুর গড়িয়েছে, তাই পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের আলো সিল্যুয়েট তৈরি করেছে।
বাড়ির সামনে বেশ দশাসই ফটক। আর উঁচু দেয়াল তো আছেই। ‘চলেন ঢুকি’, বললেন বাড়ির মালিক সবুজ সিদ্দিকী। ফ্যাশন হাউস দেশালের ব্যবস্থাপনা অংশীদার এবং চিত্রশিল্পী।
ফটক পেরোনোর পরই বিস্ময়ের ঘোর। যে ঘোর ছিল পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা। খোলা ইট আর কংক্রিটের কাঠামো, বাড়তি কোনো পলেস্তারাও নেই। লতাগুল্ম ছাওয়া পুরো বাড়ি। সামনে উঠান।
উঠান আর ঘরের মধ্যে যেন কোনো পার্থক্য নেই। বাইরের বাতাস ঘরে ঢুকছে বেরোচ্ছে সাবলীলভাবে। তখন বিকেল, সোনালি আলো-ছায়া খেলা করছে অবলীলায়। কোনোভাবেই বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে আলাদা করা যায় না। বাড়ির মানুষেরাও এটা চেয়েছেন।
যে বাড়ি নিয়ে কথা হচ্ছে, তার নাম ‘সবুজ পাতা’। এশিয়ার স্থপতিদের সংস্থা আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়ার (আর্কেশিয়া) পুরস্কার ‘আর্কেশিয়া অ্যাওয়ার্ডস ফর আর্কিটেকচার ২০২১’ পেয়েছে এই প্রকল্প। স্থপতি আছিয়া করিম ও স্থপতি নাঈম আহমেদ কিবরিয়া এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠান ইনডিজেনাস সিঙ্গেল ফ্যামিলি রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট বিভাগে সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছে। এবার ‘দ্য স্টেটসম্যান’ নামে ঢাকার একটি আবাসন প্রকল্প মাল্টি ফ্যামিলি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স বিভাগে আর্কেশিয়া পুরস্কার পেয়েছে। এর নকশা করেছেন স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেডের দুই স্থপতি শাহ্লা কে কবির ও শুভ্র শোভন চৌধুরী। ১৫টি দেশের ২২৪টি প্রকল্প থেকে ১১টি বিভাগে এবার পুরস্কার দেয় আর্কেশিয়া।
সবুজ পাতা বাড়িটি সাভার উপজেলায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে হেমায়েতপুর থেকে বাঁয়ে কিছু দূর গেলে পূর্বহাটি, এখানেই বাড়িটি। এ জায়গায় আগে যাওয়া হয়েছে, সেও আরেকটি বাড়ি দেখতে। দেশালের আরও দুই ব্যবস্থাপনা অংশীদার কনক আদিত্য ও ইশরাত জাহানের কাঠের দোতলা বাড়িতে। টালি ছাওয়া ছোট্ট পুকুরসহ সে বাড়িও প্রকৃতির অংশ।
কনক আর সবুজ—দুই বন্ধু কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে জমি কিনেছিলেন। সেখানেই বাড়ি করে বসবাস করছেন তাঁরা। সবুজ বললেন, ‘২০১০ সালে জমিটা কিনি। সাড়ে একুশ শতাংশ। এরপর গাছ লাগিয়ে দেই। আমি যখন চারুকলার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ছাত্র, তখন পরিচয় হয় বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্রী দীপা আপার (আছিয়া করিম) সঙ্গে। সে সময় আমি বলি, ‘আমার বাড়ি কিন্তু আপনি ডিজাইন করে দেবেন”।’
এই বাড়ির নকশা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আছিয়া করিম জানালেন, ‘তখন তো ক্যাজুয়ালি এসব কথা হতো। সবুজের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। একদিন সে জমিও কিনে ফেলল। ২০১৫ সালে তাঁর বাড়ির নকশার কাজ শুরু করি। প্রথমে মাথায় আসে, কনকের বাড়ি নান্দনিক এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া, তাই কাছাকাছি জায়গায় সবুজের বাড়িটাও যেন প্রকৃতির অংশ হয়ে ওঠে। এখানে সবুজদের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াটা বেশ ভালো ছিল। তাই স্থাপত্য নকশায় আমরা যেমন চেয়েছি, তারা যেমন চেয়েছে, সেটি ভালোভাবেই করা গেছে। এ বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে দুই বছর হলো।’
সবুজ পাতা আর্কেশিয়ার পুরস্কার পেয়েছে একক পরিবারের বসতবাড়ি হিসেবে। এই বাড়ির পরিবারের সদস্য চারজন। সবুজ সিদ্দিকী, তাঁর স্ত্রী কাজী তানিয়া ফারজানা এবং তাঁদের মেয়ে পাতা অংরূপিণী ও ছেলে মাহাদী মোস্তফা। বাবা ও মেয়ে দুজনের নাম মিলিয়ে বাড়ির নাম সবুজ পাতা। কাজী তানিয়া বললেন, বাসা বা ঘর ব্যক্তিগত। সেটা কত ভালো করা যায়, কত ভালোভাবে থাকা যায়, সেই চেষ্টা আমাদের ছিল। আমাদের মেয়ের বয়স নয় আর ছেলের বয়স তিন বছর। এরা প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠছে, এটাই বড় পাওয়া।’
সে নমুনাও দেখা গেল। মাহাদী এই ঘরে, তো একটু পরেই সিঁড়িতে, চোখের নিমিষেই আবার উঠানে ছুটোছুটি করছে। ১৮০০ বর্গফুটের নিচতলায় সদর দরজার পাশেই ঝুলছে বাসর লতা। কলি চলে এসেছে। সবুজ ও তানিয়া জানালেন, কিছুদিন পরই ফুল ফুটবে। মেরুনরঙা, কিছু আবার হলুদ।
বেশ বড় আকারের দরজা পেরোতেই অনুভব করা যায় বিশাল এক পরিসর। ছাদ উঁচু, ঠিক সিঁড়ি বরাবর তিনতলা পর্যন্ত ফাঁকা। নিচতলায় খাবার টেবিল পাতা, ডানে বসার ঘর। খাবার টেবিলের পরে রান্নার ঘর। একটি থাকার ঘরও আছে এই তলায়। তবে ঘরগুলো নামেই যেন ঘর। বড় জানালা, কাঠের ফ্রেমে কাঁচের দরজাগুলো ভাঁজ করা যায়। তাই পুরোটাই খোলা মনে হয়। আলো আসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। গাছপালা থাকায় সেই আলো দারুণ সব নকশা এঁকে দেয় ঘরের দেয়ালে, ঘরের মেঝেতে।
কাজী তানিয়া বলেন, ‘বাড়ির যেখানেই বসবেন, সেখান থেকেই শুধু মাথা ঘুরিয়ে আকাশ আর সবুজ দেখতে পাবেন। বাস্তুশাস্ত্রের নিয়ম মেনে বাড়ির গাছপালা লাগানো হয়েছে। এ বাড়িতে কোনো ক্যাকটাস, বনসাই নেই। দেয়ালে শিকড় বসে যায়, এমন কোনো গাছও নেই।’ তাই তো মাধবীলতা, মধুমঞ্জুরির মতো লতা ছেয়ে আছে বাড়িজুড়ে।
দোতলার ঘরগুলো বড়, খোলামেলা। দোতলায় উঠে দক্ষিণমুখী বাড়ির বারান্দা একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবুজ বললেন, ‘দোতলা ২২০০ বর্গফুটের। এখানে আমাদের সবার থাকার ঘর। প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই বারান্দা আছে, এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা দেখা যায় না। তিনতলার কিছু অংশে আমার স্টুডিও।’
বেশ বড় আকারের দরজা পেরোতেই অনুভব করা যায় বিশাল এক পরিসর। ছাদ উঁচু, ঠিক সিঁড়ি বরাবর তিনতলা পর্যন্ত ফাঁকা। নিচতলায় খাবার টেবিল পাতা, ডানে বসার ঘর। খাবার টেবিলের পরে রান্নার ঘর। একটি থাকার ঘরও আছে এই তলায়। তবে ঘরগুলো নামেই যেন ঘর। বড় জানালা, কাঠের ফ্রেমে কাঁচের দরজাগুলো ভাঁজ করা যায়। তাই পুরোটাই খোলা মনে হয়। আলো আসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। গাছপালা থাকায় সেই আলো দারুণ সব নকশা এঁকে দেয় ঘরের দেয়ালে, ঘরের মেঝেতে।
কাজী তানিয়া বলেন, ‘বাড়ির যেখানেই বসবেন, সেখান থেকেই শুধু মাথা ঘুরিয়ে আকাশ আর সবুজ দেখতে পাবেন। বাস্তুশাস্ত্রের নিয়ম মেনে বাড়ির গাছপালা লাগানো হয়েছে। এ বাড়িতে কোনো ক্যাকটাস, বনসাই নেই। দেয়ালে শিকড় বসে যায়, এমন কোনো গাছও নেই।’ তাই তো মাধবীলতা, মধুমঞ্জুরির মতো লতা ছেয়ে আছে বাড়িজুড়ে।
দোতলার ঘরগুলো বড়, খোলামেলা। দোতলায় উঠে দক্ষিণমুখী বাড়ির বারান্দা একটু বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবুজ বললেন, ‘দোতলা ২২০০ বর্গফুটের। এখানে আমাদের সবার থাকার ঘর। প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই বারান্দা আছে, এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দা দেখা যায় না। তিনতলার কিছু অংশে আমার স্টুডিও।’
সবুজ সিদ্দিকী চারুকলা অনুষদ থেকে ছাপচিত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। ২০০০ সালে ত্রয়োদশ জাতীয় নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীতে পেয়েছেন পুরস্কার। তাঁর মহিষ সিরিজের বেশ কয়টা ছবি বাড়ির বিভিন্ন দেয়ালে দেখা গেল। স্টুডিওতে আছে ছাপাই যন্ত্রও। এই স্টুডিওতে বাবার সঙ্গে পাতাও মাঝেমধ্যে ভাগ বসায়। বসে আঁকে নানান ছবি।
তিনতলার ছাদের বড় একটা অংশ খোলা। পূর্ণিমার রাতে উথাল–পাতাল আলোয় ভরে যায় পুরো বাড়ি। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, সফেদা, লোনা, বেল, পেঁপে, নারকেল, ডালিম, বড়ই, জামরুল, আঙুর ফলের নানান গাছ থাকায় পাখিরা আসে সব সময়। নানা মৌসুমে গন্ধ ছড়ায় বেলি, জবা, গন্ধরাজ, শিউলি, বকুল, কাঠগোলাপ, কনকচাঁপা, জারুল, কামিনী, কদম ইত্যাদি।
কাজী তানিয়া ও সবুজ যেমন জানালেন, সারা বছরই কমবেশি ফুলফল থাকে। আর এদেরকে ঘিরেই অনেক ধরনের পাখি আসে। ঘরে বসেই দেখা যায় দোয়েল, শালিক, চড়ুই, ঘুঘু, কাঠঠোকরা, ফিঙে, মৌটুসি, কোকিল, বুলবুলি, কানাকুয়া, হরিয়াল, বক, পানকৌড়ি, ডাহুক, পেঁচা, সরালি ইত্যাদি। লতানো গাছের ঝোপে বাসা বানায় ঘুঘু, টুনটুনিরা।
প্রকৃতির সঙ্গে মিশেল দিতে গিয়ে যেসব উপকরণ ব্যবহার করা যায়, সেসবই করা হয়েছে এ বাড়িতে, জানালেন আছিয়া করিম। বললেন, ‘জায়গার জলবায়ু বুঝে প্রকৃতি থেকে যা যা নেওয়া যায়, সেসব আমরা আমাদের সব স্থাপনায় চর্চা করে থাকি। এখানেও তাই। অনেক আগে থেকে যেহেতু তাই আগে প্রকৃতি এখানে যেমন ছিল, সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এ বাড়িতে জানালা বা দরজায় কোনো গ্রিল নেই। যাতে বাইরে প্রকৃতি দেখতে কোনো ধরনে বাধা না থাকে। আমাদের দেশের ল্যান্ডস্কেপ একটু জংলা ধরনের। যতটুকু পারা যায় এখানে সেটা ধরে রাখা হয়েছে। বসতবাড়ির বেলায় যাঁরা থাকবেন, তাঁদের স্বপ্ন পূরণের ব্যাপার থাকে। সেটা বুঝে নকশা করতে হয়। আর এটা লাইফস্টাইলের ব্যাপার। নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাই অন্যভাবে সমাধান করা হয়েছে।’
কনক আর সবুজের দুই পরিবারের সবাই সবার বন্ধু। তাই তো ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমাদের কাজ যখন শেষের দিকে কনক এলেন সবুজের বাড়িতে। হিমেল হাওয়ায় জমে ওঠে আড্ডা। কনক আদিত্য ধরেন গান—জীবন নদীর ঘাটে বসে ছোটবড় ঢেউ গুনে যাই/আশা বৃক্ষের তলে শুয়ে ঝরা পাতার গান শুনতে পাই...।