সবুজায়ন

সবুজ প্রাঙ্গণের সবুজ এক শিক্ষক

তুহিন ওয়াদুদ
তুহিন ওয়াদুদ

একসময় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রোদে খাঁ খাঁ করত। ছিল না গাছের ছায়া। দিনভর উড়ত ধুলা। গরমে হাঁসফাঁস সব সময়। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটু যে জিরিয়ে নেবেন, এরও কোনো উপায় ছিল না। সেটা ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল। শিক্ষার্থীরা ছায়ার অভাবে দিনের বেলা কোথাও বসতে পারেন না। এসব দৃশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের হৃদয়ে নাড়া দেয়।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেই শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ভাবলেন, ক্যাম্পাসকে সবুজ করতে হবে। গাছ লাগাতে হবে। এই গাছ একদিন বড় হবে। সবুজের সমারোহে ক্যাম্পাস সজীব হয়ে উঠবে।

তুহিন ওয়াদুদের সঙ্গে কথা হলো অনেক। কথায় কথায় জানালেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর গাছ লাগানোর প্রতি অনেক আগ্রহ। ‘বড় ভাইয়ের বিয়ের সময় গেট ধরে যে টাকা উপহার পেয়েছিলাম, সেই টাকায় গাছের চারা কিনে বাড়িতে লাগিয়েছিলাম। এখন বাড়ির গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে।’

নেমে পড়লেন সবুজ লড়াইয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ষষ্ঠ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৃক্ষরোপণ নিয়ে কথা বললেন তুহিন ওয়াদুদ। শিক্ষার্থীরা গাছের পরিচর্যায় আগ্রহ দেখালেন। তুহিন ওয়াদুদ নিজের বেতনের দুই হাজার টাকা দিয়ে ২০০ গাছের চারা কিনে ক্যাম্পাসে গাছ লাগানো শুরু করে দিলেন।

শুরু হলো খাঁ খাঁ ক্যাম্পাসে গাছ লাগানোর কর্মকাণ্ড। এই উদ্যোগ দেখে মিঠাপুকুর উপজেলার আবদুস সালাম বেশ কিছু আমগাছের চারা দিলেন। সেই আমগাছ বাঁশের ঘেরা দিয়ে লাগানো হলো। সেটা ২০১৩ সালের কথা।

গাছ লাগানোয় সহযোগিতা করেছেন সবাই

এরপর সবুজের পথে নামের একটি সংগঠনের কয়েকজন সদস্য এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হন। ওই সময় ক্যাম্পাসে বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। গাছ ঘিরে রাখার জন্য সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চেয়ারম্যান ফেরদৌস আলম আর্থিক সহায়তা দিলেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক আয়শা সিদ্দিকার বাবা দিলেন ইট।

সবুজ প্রাঙ্গণ

৭৫ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। এই প্রাঙ্গণ সবুজ করে তোলার প্রত্যয়ে তুহিন ওয়াদুদের গাছ লাগানোর কাজ চলতে থাকে। এ কাজে এগিয়ে আসেন অনেকেই। রংপুরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডক্টরস ও প্রাইম তুহিন ওয়াদুদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনও গাছ দিয়ে সহায়তা করেছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন রণন–এর সংগঠকেরা এ কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন। গাছের মধ্যে কখন কোন সার ও ওষুধ দিতে হবে, এসব পরামর্শ নিয়েছেন লালমনিরহাটের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা নুরুজ্জামান।

একেকটা গাছ একেকটা প্রাণ

গাছ লাগানো যত সহজ, এর পরিচর্যা ততই কঠিন কাজ। তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, প্রতিটি গাছ একেকটি প্রাণ। চারা রোপণের পর পরিচর্যা না করলে এই প্রাণগুলোকে কষ্ট দেওয়া হবে। গাছ লাগানোর পর পানি দিতে হয়। পানি কীভাবে দেওয়া সম্ভব, তা নিয়েও অনেক ভাবতে থাকেন। পানির জন্য পাইপ কিনে এনে বিভিন্ন ভবনের পানির লাইন থেকে পানি দেওয়া শুরু করলেন। এসব দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই তাচ্ছিল্য করতেন। একজন শিক্ষক হয়ে এসব কী কাজ করছেন? কেউ কেউ বারণও করেছেন। কিন্তু তিনি দমে যাননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কুক প্রদীপ চন্দ্র, প্রহরী আবদুর রহিম, নুরনবী, বুলবুল, শাজাহান, খালেদুল, শফিকুল নামের সাতজন কর্মচারী তাঁদের নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও গাছ পরিচর্যার কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন তুহিন ওয়াদুদকে। তুহিন ওয়াদুদ বললেন, তাঁদের কাজ দেখে সেদিন আমার চোখের কোণে পানি এসেছিল।

একদিন যে প্রাঙ্গণ ছিল বৃক্ষহীন, আজ সেখানে সবুজের সমারোহ। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: মইনুল হোসেন

শতাধিক প্রজাতি: ৩৩ হাজার গাছ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শতাধিক প্রজাতির প্রায় ৩৩ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কতবেল, জামরুল, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, শাল, সেগুন, সোনালু, তিন প্রজাতির চেরি, গগন শিরীষ, দেবদারু, উইপিং, কাঠগুয়া, আকাশমণি, ইপিল, রেইনট্রি, মেনজিম, মহুয়া, লম্বু, জলপাই, জাত নিম, ঘোড়া নিম, প্রায় ১০ প্রজাতির আম, পেয়ারা, কাঠগোলাপ, কাঠবাদাম, নারকেলি বাদাম, কাইজেলিয়া, তল্লি, পাঁউয়া, মেহগনি, গোলাপজাম, রিঠা, জয়তুন, আমলকী, কাঠলিচু, কাউফল, সফেদা, নারকেল, রাধাচূড়া, চন্দন, পাম, চালতা, গাব, পান্থপাদপ, কামরাঙা, আমড়া, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, বকফুল, তেঁতুল, গামারি, তাল, শিমুল আলু, রাবার, কাঁঠালচাপা, চম্পা, আলুবোখারা, পাকুর, বট, হিজল, অশোক, আগর, বরই, আতা, সাতকড়া, বেল, দারুচিনি, বিজলঘণ্টা, কদম, শিমুল, বটলব্রাশ, কমলা, আশফল প্রভৃতি।

শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এত গাছ লাগানোর জন্য ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।