আকাশ তখন রোদের দখলে। ঢাকার ধুলাবালু, যানজট পেরিয়ে বুকভরে দম নেওয়ার সুযোগ হলো আইইউবিএটি (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি) ক্যাম্পাসে পা রেখে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাঙ্গণে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) নেই, প্রয়োজনও পড়ে না। এখানে শীত ও আতপ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে ক্যাম্পাস ঘিরে রাখা গাছ, টলটলে পানির লেক। ঢাকায় উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরে ১৭ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে পড়ছেন প্রায় সাড়ে সাত হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকার আনাচকানাচ থেকে বিনা খরচে রোজ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিচ্ছে ৪০টি বাস। কেমন কাটছে তাঁদের ক্যাম্পাস জীবন? জানতে গত মঙ্গলবার হাজির হয়েছিলাম আমরা। ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল, বড় করে লেখা আছে—অ্যান এনভায়রনমেন্ট ডিজাইনড ফর লার্নিং।
প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়
আইইউবিএটির একাডেমিক ভবনের নিচতলার দেয়ালজুড়ে অনেকগুলো ছবি, যেখানে ফুটে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস। একেকটি ছবির পেছনের গল্প বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ সেলিনা নার্গিস। তিনি আইইউবিএটির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত শিক্ষাবিদ এম আলিমউল্যা মিয়ানের স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক এম আলিমউল্যা মিয়ান। আইইউবিএটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে।’
‘সে সময় বোধ হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরাই পড়ত।’ দুদিকে মাথা নেড়ে আমাদের থামিয়ে দেন অধ্যাপক সেলিনা নার্গিস। তিনি নিয়ে গেলেন আইইউবিএটির নিচতলার উন্মুক্ত মিলনায়তনে। মঞ্চের ওপরে বড় করে লেখা আছে, ‘প্রত্যয়: যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তা—প্রয়োজনে মেধাবী তবে অসচ্ছলদের জন্য অর্থায়ন।’ দেখিয়ে অধ্যাপক বললেন, ‘আইইউবি এটি প্রতিষ্ঠার সময় আলিমউল্যা মিয়ান বলেছিলেন, শুধু টাকার অভাবে কেউ পড়তে পারছে না, আমাদের এখানে যেন এমনটা কখনো না হয়।’ সেই প্রত্যয় ধরে রাখার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
নানা রকম বৃত্তির সুযোগ আছে আইইউবিএটিতে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেলে শতভাগ বৃত্তিতে পড়তে পারেন শিক্ষার্থীরা। মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহিত করতে ১৫% বিশেষ বৃত্তিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫৭টি বৃত্তি দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, এখানে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা সুদে ঋণ নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। ‘ঋণ’ শব্দটা অবশ্য এখানে ঠিক জুতসই হলো না। নিয়মটা এমন, দরিদ্র ছেলেমেয়েরা বিনা পয়সায় পড়বে, পরে চাকরি পেয়ে সে টিউশন ফি পরিশোধ করে দেবে। আইইউবিএটি থেকে অনেকেই এভাবে স্নাতক শেষ করেছেন, এখন ভালো অবস্থানে আছেন।
তাঁদের মধ্যে একজন, এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেডের (স্বপ্ন) মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান শাহ মো. রিজভী। তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ হলো। ২০১১ সালে আইইউবিএটি থেকে স্নাতক শেষ করেছেন, এখনো শাহ মো. রিজভীর কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা। তিনি বললেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো আর্থিক অবস্থা আমার ছিল না। সরাসরি আলিমউল্যা মিয়ান স্যারের রুমে ঢুকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমার আগ্রহ দেখে স্যার শতভাগ বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রতি সেমিস্টারে একটা রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। আমি যেন পরে চাকরি করে টাকাটা পরিশোধ করে দিতে পারি, স্যার সেই ব্যবস্থাও করলেন। সেই সময় এটুকু সহযোগিতা আমার খুব দরকার ছিল।’
পড়ালেখায় আধুনিকতা
‘এই যে দেখুন, আমাদের বানানো গাড়ি।’ মোবাইলে ভিডিও দেখিয়ে বলছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুস সাকিব। সাকিব আর তাঁর বন্ধুরা মিলে তৈরি করেছেন একটি সৌরচালিত গাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে উদ্ভাবন ও গবেষণার পরিবেশ গড়ে তুলতে আগ্রহী, সে কথাই বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুর রব। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হয়। মুশকিল হলো, সে জন্য যতটা অর্থায়ন প্রয়োজন, সেটা আমাদের নেই। তবু, আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ সেন্টার আছে।’
আইইউবিএটিতে প্রায় শতভাগ শিক্ষক পূর্ণকালীন চাকরি করছেন, সে কথাও জোর দিয়ে বললেন অধ্যাপক আবদুর রব। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো বিষয় পড়ানোর জন্য হঠাৎ করেই একজন শিক্ষকের প্রয়োজন হয়, তখন আমরা পার্ট টাইম শিক্ষক নিই। হুট করে তো কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায় না। এ ছাড়া আমাদের এখানে শতকরা ৯৯ ভাগ শিক্ষকই পূর্ণকালীন।’
কৃষি গবেষণার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে আইইউবিএটি। অন্যান্য বিষয়েও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। বিবিএ, প্রকৌশল, কৃষি, অর্থনীতির পাশাপাশি ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট এবং নার্সিং বিষয়েও স্নাতক করার সুযোগ আছে। এ ছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমবিএ পড়ানো হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি নানা রকম সহশিক্ষা কার্যক্রমে সারা বছর ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জাতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আসর বসেছে এই ক্যাম্পাসে।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের চাকরির উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের পেশা বিষয়ক কর্মশালা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আইইউবিএটির ‘প্লেসমেন্ট অ্যান্ড স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স’ কার্যালয়। তাই পাশ করার পরপরই আইইউবিএটির স্নাতকদের চাকরিতে প্রবেশ করা সহজ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় স্রেফ একটি ভবন নয়। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ‘গ্রিন ক্যাম্পাস’। তাই ছাত্রছাত্রীরা এখানে পা রেখে শুধু বুকভরে নিশ্বাসই নয়, উদ্যম আর আত্মবিশ্বাসও গ্রহণের সুযোগ পান।