শ্রীলঙ্কায় বাংলা ভাষার জয়গান

শ্রীলংকায় একুশে ফেব্রুয়ািরর অনুষ্ঠানে ছবি আঁকছেন এক শিল্পী। ছবি: সংগৃহীত
শ্রীলংকায় একুশে ফেব্রুয়ািরর অনুষ্ঠানে ছবি আঁকছেন এক শিল্পী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বাইরে শ্রীলঙ্কায় তিন বছর ধরে কিছুটা ভিন্ন আবহে পালন করা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি। বিশেষ করে ভাষা, রক্তদান আর সংগীতকে এক সুতোয় গাঁথার ভাবনা থেকে ২০১৭ সাল থেকে এ উদ্যোগ নিয়ে আসছে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ হাইকমিশন। গত দুই বছরের মতো এবারও একটি প্রতিপাদ্য সামনে রেখে কলম্বোর বিহারা মহাদেবী পার্কে পালিত হয়েছে দিনটি। ‘ভাষার জয়গান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের আয়োজনে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকার ১৫টি দেশ।

এবারের আয়োজনে ৬টি স্কুলের প্রায় ২২৫ জন শিক্ষার্থী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। তারা ছবি আঁকে। সংগৃহীত হয় ৯৮ ব্যাগ রক্ত। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকার কারু জয়সুরিয়া ছাড়াও দেশটির মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য ও ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত অংশ নেন।

কলম্বোতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আয়োজনের কথা বলতে গিয়ে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ জানালেন, ২০১৬ সালের শেষ দিকে প্রথমবারের মতো তিনি দেখা করতে যান শ্রীলঙ্কার জাতীয় অন্তর্ভুক্তিকরণ, রাষ্ট্রীয় ভাষা ও সামাজিক অগ্রগতিবিষয়ক মন্ত্রী মানু গণেশনের সঙ্গে। অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার পর শ্রীলঙ্কার মন্ত্রীর সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন নিয়ে কথা বলেন হাইকমিশনার। একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তাবে উৎসাহ দেখান মানু গণেশন। এরপর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা যৌথভাবে পালন করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি।

 ২০১৭ সালে প্রথম আয়োজন থেকেই একটি প্রতিপাদ্য সামনে রেখে পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয়। প্রথম বছরের প্রতিপাদ্য ছিল শান্তি, সাযুজ্যতা, স্থিতিশীলতা আর সবার সমৃদ্ধির জন্য ভাষা। গতবার প্রতিপাদ্য ছিল বন্ধনের জন্য ভাষা। আর সেই প্রতিপাদ্য অনুযায়ী পোস্টারের নকশা করা হয়। গ্রন্থনা করা হয় পুরো অনুষ্ঠানের।

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা

প্রতিবছর কলম্বোর ইউনিভার্সিটি অব ভিজ্যুয়াল অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টসের একদল শিক্ষার্থী সেন্ট্রাল পার্কে বাংলা-সিংহলি-তামিল ভাষার জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করেন। সারা দিন তাঁদের বাঁশি আর ভায়োলিনের মূর্ছনা আকৃষ্ট করে দর্শক-শ্রোতাদের। কলম্বোতে জাতীয় জাদুঘরের পাশে বিহারা মহাদেবী পার্কে আলতাফ মাহমুদের সুর করা অমর গানটি ইউনিভার্সিটি অব ভিজ্যুয়াল অ্যান্ড পারফর্মিং আর্টসের শিক্ষার্থীদের বাঁশি-বেহালা-হারমোনিকায় সৃষ্টি করে অন্য এক দ্যোতনা।

ভিন্ন আবহে একুশ পালনটা তো চার দেয়ালের মধ্যেও হতে পারত। বাইরে কেন? এ নিয়ে রিয়াজ হামিদুল্লাহর ব্যাখ্যা হচ্ছে, কলম্বোর সেন্ট্রাল পার্কে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা পার্লামেন্টের স্পিকার যখন কথা বলছেন, তখন তাঁকে দেখে লোকজন থামছেন। তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের অপেক্ষায় থাকছেন। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষার পর তাঁরা বুঝতে পারছেন আয়োজনের পুরোটাই ভাষা নিয়ে। ভাষার শক্তি আর বন্ধনটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এটাই তো সবচেয়ে বড় সুযোগ। প্রথম বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে সেন্ট্রাল পার্কের আশপাশে তো রীতিমতো যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য।

 ২০১৭ সালে ১৩৭ ব্যাগ আর ২০১৮-তে ১৪০ ব্যাগ রক্ত সংগৃহীত হয়েছিল। সেই রক্ত পরে দেওয়া হয়েছিল শ্রীলঙ্কার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। আর এই রক্তদানের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য বরকত-জব্বার-সালামদের আত্মাহুতির বাণী পৌঁছে দেওয়া গেছে। শেষ পর্যন্ত ভাষার মতো রক্তও বন্ধনের বড় এক প্রতীক।

বিদেশের মাটিতে তিন বছরের এই আয়োজনে আরেকটি বিষয় চোখে পড়ার মতো। ২০১৭ সালের পোস্টারে দেখা যায় বেশ কিছু সাংকেতিক ভাষার প্রতীক। আমাদের চারপাশে অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ বলতে কিংবা শুনতে পান না। ভাষা দিবসে তাঁদের কথা ভেবে সবাইকে যুক্ত করার মানসে এটা করা হয়েছে।

এবারের পোস্টারে যেসব বক্তব্য লেখা হয়েছে, তার শেষটা এ রকম...

আসুন সবাই একে অন্যের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলি। একে অন্যের ভাষা শ্রদ্ধা করি। গান গাই একে অপরের ভাষায়। ভাষা আমাদের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করুক। মাকে যতটা ভালোবাসি, ভাষাকেও সেভাবে ভালোবাসতে দিন।