শৈশবে যাকে যমের মতো ভয় পেতাম, সে-ই হয়ে গেল বন্ধু

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিবস উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

গত রমজান মাসে আমাদের বাসায় এক লোক এলেন। বয়স ৩০ কি ৩৫ হবে। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ আর একটা জ্যান্ত মুরগি। দরজা খুলতে খুলতে আম্মা জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’

‘স্যার আছে? স্যারের কাছে এসেছি।’

আম্মা বলল, ‘কী দরকার?’

লোকটি বললেন, তিনি একজন সবজি বিক্রেতা। কয়েক বছর আগে আব্বু নাকি তাঁর কাছ থেকে সবজি কিনেছিল। তখন তিনি আব্বুকে বলেছিলেন, তাঁর বাবা অসুস্থ। আব্বু তখন তাঁকে ৩০০ টাকা দিয়েছিল। সে সময় সেই টাকাটা তাঁর খুব কাজে লেগেছে। এরপরে তিনি গ্রামে চলে যান। আজ এত দিন পরে তিনি আব্বুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন তাঁর বাড়ির গাছের ১০টা বেল আর একটা মুরগি।

আম্মা যখন বলল, ‘তিনি আর নেই। পাঁচ মাস আগে চলে গেছেন’—শোনার পর লোকটি কেঁদে ফেললেন।

আব্বুর চলে যাওয়ার পরে এ রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে।

খুব অল্পে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অসামান্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিল আমার বাবা। স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষায় আমার রোল যেবার ৪৮ হলো (৫০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে), মা মুখ–চোখ কালো করে বাবাকে বোঝাল, ছেলে গোল্লায় যাচ্ছে!

কঠিন এক পিটুনি খাওয়ার জন্য আমি মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু দেখলাম, পরীক্ষায় ৪৮ রোল হওয়া যে কোনো তুচ্ছ ব্যাপার নয়, সেটা নিয়ে বাবা মাকে একটা লম্বা লেকচার ঝেড়ে দিল।

আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল রহস্য পত্রিকায়। সম্মানী পেয়েছিলাম ৮০ টাকা। পরের গল্পটা এক পৃষ্ঠা বেশি লিখেছিলাম। সম্মানী পেলাম ১২০ টাকা। সেটা আমি বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বাবা বড় একটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছিল। ১২০ টাকায় ইলিশ মাছ পাওয়ার কথা নয়! নিশ্চয়ই ওই টাকার সঙ্গে আরও যোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু সবাইকে বাবা গলা উঁচু করে বলেছিল, ছেলের লেখার টাকা দিয়ে সে ইলিশ মাছ কিনে এনেছে। শৈশবে যে বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম, একটু বড় হতেই সে–ই বাবা হয়ে গেল বন্ধু। অথচ এখন ভাবলে অবাক লাগে, কখনো তাঁকে একটা চুমু পর্যন্ত খাইনি। যদি কখনো বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ হয়, বাবার কপালে একবার চুমু খেতে চাইব।

এমএ পরীক্ষা দিয়ে আমি যখন বললাম, লেখালেখি নিয়ে থাকতে চাই। অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। আমার মা-ও খানিকটা গাঁইগুঁই করেছিল। তার খুব ইচ্ছা ছিল, তার ছেলেরা নয়টা-পাঁচটা অফিস করবে। একমাত্র আমার বাবা বলেছিল, ও যা চায় তা–ই করুক।

১৯৭১ সালে বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সে প্রথম গেল বরিশালে, নিজ গ্রামে। তারপর ভারতে ট্রেনিং নিতে। একই পরিবার থেকে তাঁরা চার ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

মেট্রোরেল আর পদ্মা সেতু নিয়ে মহা উৎসাহ ছিল তার। পদ্মা সেতুর একেকটা স্প্যান বসানোর খবর যখন টিভিতে দেখানো হতো, তার আনন্দ দেখে কে! তার খুব ইচ্ছা ছিল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবে!

সে মাঝেমধ্যে একটা কথা বলত, একটা ভালোবাসা একটা ভালোবাসার জন্ম দেয়। একটা ঘৃণা একটা ঘৃণার জন্ম দেয়!

এ মানুষটা আজীবন ভালোবাসার জন্ম দিয়ে গেছে। শেষ কয়েক বছর সে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে বাসা থেকে একেবারেই বেরোতে চাইত না। রাস্তায় বেরোলে তার নাকি পৃথিবী দুলে উঠত! মানুষটা চলে গিয়ে আমাদের পৃথিবী চিরতরে দুলিয়ে দিয়ে গেল। এখনো প্রায়ই পথ চলতে অসংখ্যবার দুলে উঠি চাপা কান্নায়, নিজের অজান্তেই।