ডেঙ্গু এখনো মূর্তিমান আতঙ্ক। একদিকে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি অন্যদিকে আছে মশা তাড়াবার মতো শক্তির অভাব—এ রকম বিভিন্ন কারণে শিশুরা একটু বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ছোট্ট শিশুরা দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়, এটিও আরেক কারণ।
স্কুলে যায় যে শিশুরা তারাও আছে বাড়তি ঝুঁকিতে। একটি ক্লাসে অনেক পরিবারের শিশু থাকে; ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে তারা বয়ে আনতে পারে ডেঙ্গু ভাইরাস। দিনের বেলা অনেক ক্লাস রুমে মশার প্রকোপ থাকে। শিশুরা যখন ক্লাস করতে স্থির হয়ে বসে, মশা তখনই কামড় বসানোর সুযোগ পায়।
শিশুদের ডেঙ্গু হলে
শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ অনেকটা বড়দের মতোই হয়। জ্বর, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, চোখ ব্যথা, বমির ভাব কিংবা বমি, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ইত্যাদি হলো ডেঙ্গুর লক্ষণ। সাধারণত মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ১০ দিনের ভেতর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। এই সময় শিশুকে মশারির ভেতর রাখা উচিত। জ্বর ভালো হওয়ার পরও শিশুদের দশ দিন পর্যন্ত মশারির ভেতর রাখা উচিত, যাতে অন্যদের মধ্যে এই রোগ না ছড়ায়
যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন
এই সময়ে শিশুদের জ্বর হলে বা ডেঙ্গু সন্দেহ হলে ১-৩ দিনের ভেতর ডেঙ্গু এন এস ওয়ান (NS1) ও কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (CBC) পরীক্ষা করাতে হবে। রোগের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য রক্তের হিমাটোক্রিট ভ্যালু এবং রক্ত চাপ মূলত গুরুত্বপূর্ণ।
ডেঙ্গু হলে ঘন ঘন তরল খাবার দিতে হবে। পানি, লেবুর শরবত, ফলের শরবত, স্যালাইন, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে দেবেন। আপনার শিশু নিয়মিত প্রস্রাব করছেন কিনা তা খেয়াল রাখবেন। ছয় ঘণ্টার ভেতর একবারও প্রস্রাব না করলে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
জ্বর হলে শিশুদের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা বেশি হয় সেটা হলো, শিশুরা খেতে চায় না। পর্যাপ্ত খাবার না খেলে সেটাকে ডেঙ্গুর বিপদ চিহ্ন বা ওয়ার্নিং সাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া পেট ফুলে গেলে, বমি হলে বা পাতলা পায়খানা হলেও সেটা ওয়ার্নিং সাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অবস্থায় শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি।
চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই বলে আমরা সবাই জানি। জ্বরের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় প্যারাসিটামল সিরাপ ও ঘন ঘন স্পঞ্জিং করা যেতে পারে। ৩-৫ দিন পর্যন্ত জ্বর থাকে। জ্বর চলে যাওয়ার পরই সাধারণত রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
প্লেইটলেট নিয়ে আতঙ্ক নয়
প্লেইটলেট নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু জ্বরে খুব কম ক্ষেত্রেই প্লেইটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হয়। রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা না দিলে সাধারণত প্লেইটলেট দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্লেইটলেট ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা নয়। প্লেইটলেট দেখে রোগীর তীব্রতা বা ভালোমন্দ নির্ধারণ করা হয় না। তাই ঘন ঘন প্লেইটলেট কাউন্ট দেখার দরকার নেই। রক্তচাপ দেখাটা বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডেঙ্গুর প্রধান বিপদটি হলো ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’। ভাইরাসের কারণে রক্তনালির ছিদ্রগুলো যখন বড় হয়ে যায়, তখনই রক্ত থেকে জলীয় উপাদান বেরিয়ে যায়। ফলে তখন রক্তচাপ কমে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। একেই বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ভয়ংকর বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
শিশুদের প্রস্রাব কম হলে, হাত পা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে, অজ্ঞান হয়ে গেলে অথবা শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে শিশুর শক সিনড্রোম হতে পারে। এ সময় চিকিৎসক বা হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকা খুব জরুরি।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:
১. শিশুদের ফুল স্লিভ জামা প্যান্ট পরিয়ে রাখুন।
২. দিন বা রাত যখনই শিশু ঘুমাক না কেন তাকে মশারির ভেতরে রাখতে হবে।
৩. মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য রিপেলেন্ট লোশন ব্যবহার করা যেতে পারেন। এতেও কিছুটা কাজ হয়।
৪. নিজেদের বাড়িঘর, কার্নিশ ও ছাদে আটকে থাকা স্থির পানি, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র, তা ধ্বংস করুন।
সুস্থ আগামীর জন্যই আমাদের শিশুদের সুস্থ রাখা জরুরি।
ডা. গুলজার হোসেন, রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ