শাসক থেকে শোষিতের হাতে

লর্ডসে ইংল্যান্ডের দেওয়া টার্গেট ৩২৬ রানকে অতিক্রম করতে পেরে প্যাভিলিয়নে জার্সি খুলে মাথার ওপর ঘোরাচ্ছেন সৌরভ গাঙ্গুলী, ১৩ জুলাই ২০০২। এটি যেন শাসককে পরাস্ত করে শোষকের বিজয়চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
লর্ডসে ইংল্যান্ডের দেওয়া টার্গেট ৩২৬ রানকে অতিক্রম করতে পেরে প্যাভিলিয়নে জার্সি খুলে মাথার ওপর ঘোরাচ্ছেন সৌরভ গাঙ্গুলী, ১৩ জুলাই ২০০২। এটি যেন শাসককে পরাস্ত করে শোষকের বিজয়চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

‘ক্রিকেটপাগল মানুষ ক্রিকেট ছাড়া আর বোঝেটা কী?’
ক্রিকেট নিয়ে লেখা বিখ্যাত বেয়ন্ড আ বাউন্ডারি বইয়ে ক্যারিবিয়ার লেখক সি এল আর জেমস বিদ্রূপের ছলে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন। বিদ্রূপটা ছিল ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশদের প্রতি, যারা সেখানে খেলাটির প্রচলন করেছিল। বর্ণনায় ক্রিকেটকে জেমস নিছক একটি খেলা হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে। দেখিয়েছেন ক্রিকেট কীভাবে একাধারে শাসকের সংস্কৃতির অংশ, আবার সেই শাসকেরই বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র। জেমসের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী পরবর্তীকালে খেলাটিকে উল্লেখ করেছেন ‘দৃষ্টি ফেরানো’ হিসেবে; পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান থেকে চোখ ফিরিয়ে ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকে নজরে রাখার সুযোগ হিসেবে ক্রিকেট ছিল শাসিত জনগোষ্ঠীর এক জরুরি মাধ্যম।
ক্রিকেট এমন খেলা, যা আবিষ্কার আর ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ উচ্চবিত্তের আয়ত্তে থাকা খেলাটি পরে ভারতীয় অর্থে আর তারই রাজনৈতিক প্রয়োজনে বেড়ে ওঠে। তাই বিংশ শতাব্দীতে ভারতে ক্রিকেটের প্রসারের কথা বলতে গেলে ‘গ্লোবালাইজেশন’ না বলে বরং ‘ইন্ডিয়ানাইজেশন’ বলা ভালো। ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদ ও লেখক আশিস নন্দী তাঁর প্রবন্ধে বলেন, ক্রিকেট মূলত ভারতীয় খেলা, যা দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কৃত হয়েছে ইংল্যান্ডে। ঠিক যেমন মরিচ কোনো ভুলে দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপন্ন হয়ে মধ্যযুগে ভারতে এসে শেষে ভারতীয় খাবারের অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, আরও পরে বাংলাদেশে ক্রিকেটের উত্থান পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার অভাবনীয় উদাহরণ, যার পেছনে দায়ী রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু এককালের ঔপনিবেশিক শক্তির উচ্চশ্রেণির দখলে থাকা খেলা কী করে অতীতের শোষিত সাধারণ মানুষের হাতে চলে যায়?
ইউরোপের বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক ও সমালোচক নেভিল কার্ডসের মতে, দর্শকই ক্রিকেটের প্রাণ আর তার সঙ্গে প্রয়োজন রচনা বা সাহিত্য; ক্যারিবীয় তথা সারা পৃথিবীর জন্য যা করেছেন সি আর এল জেমস। একইভাবে বেসবল বা রাগবি নিয়ে হাজার রচনা আমেরিকায় খেলাগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলে। দর্শক আর সাহিত্য—এই দুইয়ে মিলে খেলার ইতিহাস রচিত হয়। খেলার ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাক্ষী। দেখা যায়, অতীতের ব্রিটিশ উপনিবেশ যেসব স্থানে বিকাশ লাভ করেছিল, ক্রিকেটও বিকশিত হয়েছে ঠিক সেসব স্থানে। এখন নিষ্পাপ কণ্ঠে কেউ জানতে চাইতে পারে, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর যেখানে জাতীয়তাবাদের উত্থানের জোয়ারে ঔপনিবেশিক অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করার কথা, সেখানে ক্রিকেটকে আমরা আঁকড়ে ধরলাম কেন? দিন শেষে জাতীয়তাবোধ নিজেই একটি বৈশ্বিক ধারণা। অখণ্ড ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকায় উপনিবেশ-পরবর্তীকালে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা সেই প্রমাণ বহন করে। আবার ঔপনিবেশিকতা কেবল একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ নয়, সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বজনীন হওয়ার পথে এক অধ্যায়ও। ঔপনিবেশিকতা শাসক ও শোষিত—দুইয়ের ওপরই গভীর ছাপ ফেলে, যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা বয়ে বেড়ায়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার নৃতত্ত্ববিদ অর্জুন আপাদুরাই মনে করেন, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হতে চাওয়া আসলে অতীতের ঔপনিবেশিক আমলের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বোঝাপড়া। অন্যদিকে বহুদিনের অভ্যাস বা জীবনাচরণ চাইলেই চট করে বদলে ফেলা যায় না। তাই সচেতনভাবে হোক বা না হোক, আমরা বহু প্রজন্মের অভ্যাসসমেত বৈশ্বিক আচরণের দিকে ধাবিত হই। আবার বৈশ্বিক হতে চাইলেই কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদের চেতনা মরে যায় না। বিদেশের মাটিতে দুজন বাঙালির দেখা হলে তারা দেশি সংস্কৃতি-সাহিত্যের আলাপই করে বেশি।
ক্রিকেট যেখানে ভারত বা বাংলাদেশে জীবন-মরণ, সেখানে সেভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ হয়ে না ওঠা মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে সামান্য কৌতূহলমাত্র। আর দর্শক যেহেতু খেলার প্রাণ, তাই বারবারের চেষ্টায়ও ক্রিকেট এসব স্থানে প্রসার লাভ করেনি, যা বিনা চেষ্টায় করেছে অখণ্ড ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ওদিকে আমেরিকায় কেন করেনি? অনেকটা সেই একই কারণে হয়তো। ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্ক ছিল না। তাই কিছুদিন খেললেও অভ্যাসটির সঙ্গে তারা বেড়ে উঠতে পারেনি। তা ছাড়া আমেরিকার মানুষের জীবন দ্রুতগামী, যা হয়তো বেসবল, রাগবি বা সকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ক্রিকেটের মতো ধীরলয়ের একটা খেলায় মেতে ওঠার মনমানসিকতা এক বিশেষ সাংস্কৃতিক আচার। ক্রিকেট ধীরেসুস্থে দিনের পর দিন চলে, চলে অনির্ধারিত সময়ের জন্যও; একবার ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে খেলা শুরু হলো আর চলতেই থাকল। ফাঁকে ফাঁকে তিন দিনের বিরতিসহ ১৩ দিন পর অমীমাংসিতভাবেই শেষ হলো। কারণ, ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের দেশে ফেরার জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছিল।
ক্রিকেট খেলোয়াড়দের আগে সাদা পোশাকে দেখা যেত। জ্যাক উইলিয়ামসের ক্রিকেট অ্যান্ড ইংল্যান্ড বইয়ে উল্লেখ আছে, ভিক্টোরিয়ান আমলের মানুষের প্রিয় খেলা হিসেবে ক্রিকেট ছিল খ্রিষ্টীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ সংস্কৃতির ধারক, যাকে তারা বলত ‘জেন্টলমেনস গেম’। তাই খেলোয়াড়দের থাকতে হতো বিশুদ্ধতা বা ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে, যা ইউরোপে সাদা রঙে বোঝানো হতো। ঔপনিবেশিক শক্তি শোষিতের ওপর নিজস্ব সংস্কৃতির ভার চাপায়। তেমনি সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ক্রিকেটকে ইংরেজ একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিল মাত্র। এর মাধ্যমে তারা ভিক্টোরিয়ান আমলের নীতি ও রুচির বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিল। আর চেয়েছিল শোষিতের মধ্যে উচ্চশ্রেণির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে। অর্জুন আপাদুরাইয়ের মতে, শোষিতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে দাপ্তরিক কাজের বাইরে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে আরও বেশি করে শোষণের উপায় খুঁজে বের করা ছিল ইংরেজের অভিসন্ধি। উপনিবেশমুক্ত হওয়ার পর যখন জাতীয়তাবাদী নেতারা ইংরেজের শেখানো অভ্যাস থেকে জাতিকে মুক্ত করায় সচেষ্ট ছিলেন, তখন অল্প কিছু নেতাই ক্রিকেটের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে একটি আচার ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এলেও তা বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে যেতে সময় লাগে না, ক্রিকেটের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল অস্বাভাবিক দ্রুত। অর্জুন আপাদুরাইয়ের রচনায় জানা যায় যে সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর দিকে ভারতে আসা পারস্যের অভিবাসনকারীরা ইংরেজ ও ভারতীয় সংস্কৃতির আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সেতু হিসেবে কাজ করত। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও তারা ছিল অগ্রণীর ভূমিকায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে ক্রিকেটের প্রসারে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট–উন্মাদনার কারণ সাকিব আল হাসানের মতো নাম্বার ওয়ান ক্রিকেটাররা। ছবি: শামসুল হক

তারপরও ঠিক কোন কারণে একটি দেশে নির্দিষ্ট একটি খেলা প্রসার লাভ করে? আমেরিকার লেখক মার্কোভিটস ও হেলেরম্যানের অফসাইড: সকার অ্যান্ড আমেরিকান এক্সেপশনালিজম বইয়ে তাঁরা হেজিমনিক খেলার কথা উল্লেখ করেছেন। দেশটিতে সকার নিয়মিত খেলা হয়, লিগ থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ হয়, তবু সকার নিয়ে সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ আলাপ করে না; ভক্তের সংখ্যা বেশি রাগবি আর বেসবলের। তাই লেখকদ্বয়ের মতে, খেলার হেজিমনি সংস্কৃতি তখনই গড়ে ওঠে, যখন খেলাটির সঙ্গে দেশের মানুষের আবেগ জড়িত থাকে। কিন্তু ভক্তের সঙ্গে খেলার আবেগময় সম্পর্কের কি কোনো মাপকাঠি আছে? মাপকাঠি আছে কেবল কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের: দেশটির সংবাদপত্রে কি খেলাটির খবর নিয়মিত আসে? টেলিভিশনে কি সরাসরি সম্প্রচারিত হয়? ব্যবহারিক পণ্যদ্রব্যের প্রচারে কি খেলোয়াড়দের মুখ দেখা যায়? মানুষ কি এখানে-সেখানে খেলাটি নিয়ে প্রায়ই আলাপ করে? বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যাপারে উত্তরগুলো আমাদের জানা। ২০১৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পত্রিকায় ক্রিকেটের খবর প্রচারে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ভারতের অবস্থান সামান্য নিচে, আর ওপরে অবস্থান করছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের জন্য ক্রিকেট হেজিমনিক খেলা হয়ে গেছে অনেক আগে। ক্রিকেট সেই সৌভাগ্যের সিঁড়ি, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটিকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরবে, তা আমরা অনেক আগে জেনে গেছি।
টেলিভিশনে প্রচারের উপযোগী খেলা বলতে ক্রিকেটের মতো দ্বিতীয়টি নেই, যাতে আছে উত্তেজনা আবার আছে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগও। দর্শক ঘুরেফিরে দিনভর খেলা দেখতে অভ্যস্ত। ওদিকে বিরতিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আয় বাড়ানোও সহজ। একসময় টেলিভিশনের বহুল ব্যবহার ক্রিকেটকে প্রচারে সাহায্য করেছে। অন্যপক্ষে খেলাটির জনপ্রিয়তা গণমাধ্যমকে অভাবনীয় হারে আয় বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। একে অপরের হাত ধরে চলতে চলতে খেলাটি হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী তুমুল আয়ের উৎস।
আর হবে নাই-বা কেন, মানুষের ন্যূনতম আশ্রয়ের চাহিদা যখন হয়ে দাঁড়ায় বহুতলবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, জ্ঞান বিতরণকারী শিক্ষা হয়ে ওঠে প্রাতিষ্ঠানিক দৌরাত্ম্যের কার্যকলাপ, চিকিৎসাসেবার পরিবর্তে হয়ে যায় ভোগ, তখন খেলাই-বা ব্যবসা হবে না কেন! ক্রিকেট সফলভাবে বিলিয়ন ডলার অর্জনকারী ব্যবসা হয়েছে। শুধু ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগই বছরে ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে। ওদিকে বিচিত্র পণ্যদ্রব্যে লোগোর ব্যবহার থেকে শুরু করে ম্যাচকে কেন্দ্র করে হাজার রকমের ব্যবসার জাল পাতা। তা ছাড়া খেলার সরঞ্জাম বা পোশাক বিক্রির ব্যবসাও খেলার চেয়ে কম বড় নয়, যা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ দলের দিকে ধাবিত; যেমন স্ল্যাজিঞ্জার কোম্পানি একসময় অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচুর ব্যবসা করলেও তাদের বর্তমান মনোযোগ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বাজারে।
লেখক ও ইতিহাসবিদ কেইথ স্যান্ডিফোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট শাসক ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির দখলে ছিল। এরপর থেকে যুক্ত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। লেখক বেন ক্যারিংটন তাঁর মার্ক্সিজম, কালচারাল স্টাডিজ অ্যান্ড স্পোর্টস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শোনা যায়, কার্ল মার্ক্স একবার ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, নিম্নবিত্ত শোষিত শ্রেণি যদি উচ্চবিত্ত শাসকশ্রেণির সঙ্গে এমন ধীরলয়ের খেলায় ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতে থাকে, তবে ইংল্যান্ডে বিপ্লব এক দুরাশা। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উডরো ওয়াট একই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ক্রিকেট যে জাতির জনপ্রিয় খেলা, তারা হয়তো কখনোই কমিউনিজমের স্বাদ পাবে না।
বস্তুত, সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণে একসময় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ শুরু হয়, যাতে তাদের খেলার দিকে আরও বেশি টেনে আনা যায়। দর্শক-খেলোয়াড়-আয়োজকের ব্যবসা বাড়তে বাড়তে কেবল ‘ভদ্রলোকের খেলা’ ইমেজ ঘুচে গিয়ে খেলাটি ধীরে ধীরে পণ্যে পরিণত হয়; খেলাকেন্দ্রিক ক্ষমতা শাসকশ্রেণির হাত থেকে শোষিতের হাতে চলে যায়। ঔপনিবেশিক আমলের মতো খেলোয়াড়দের শ্রমজীবী শ্রেণি গণ্য করলে পরবর্তীকালে তাদের অপরিমেয় উন্নয়ন ঘটে। নিজেদের উপস্থিতি ও সুনাম তারা উচ্চ মূল্যে লেনদেন করতে পারে। কেউ অংশগ্রহণ করে, কেউ দেখে, কেউ বিক্রি করে, কেউ কেনে, তবে খেলার সঙ্গে জীবনের সম্বন্ধ গড়ে ওঠায় কোথাও বিনোদনের কমতি হয় না। ফ্রেঞ্চ সমাজবিজ্ঞানী পিয়ার বোর্দ্যুর সূত্র আবারও প্রমাণিত হয়, সমাজে সমগ্রভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ঐতিহাসিক যাত্রাই আধুনিকতার মূল। ক্রিকেট লাভজনক ব্যবসা, যা খেলোয়াড়-আয়োজক-দর্শকনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে সামনে এগিয়ে যায়। তবে যেতে যেতে প্রশ্ন রেখে যায়, ব্যবসাটি লাভজনকতর হওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলার আনন্দ কি শেষে পথেই কোথাও যাবে হারিয়ে? খেলাকে ক্রমশ পণ্যে পরিণত করতে করতে খেলোয়াড়-আয়োজক-দর্শকের কপালে কি খেলার নামে আনন্দের বদলে ভয়ানক মানসিক চাপই থাকবে লেখা?
পরিশেষে আবারও গণমাধ্যমের কথা; ক্রিকেট যে একসময় ব্রিটিশদেরই উল্টো রথে ঘোরাতে শুরু করে, তার একটি চমৎকার চিত্রায়ণ আছে লগন নামের ভারতীয় সিনেমায়। ঔপনিবেশিক আমলের পটভূমিতে দেখা যায়, শাসকশ্রেণি প্রজাদের কর মওকুফ করে দেওয়ার বাজি ধরে তাদের ক্রিকেট ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে বলে। জিতলে কর মওকুফ, কিন্তু হারলে প্রজাকে দিগুণ কর গুনতে হবে, এই থাকে শর্ত। কর মওকুফের প্রলোভন দেখিয়ে অজানা খেলায় প্রজাদের হারিয়ে দ্বিগুণ হারে শোষণ করার পরিকল্পনা নেয় তারা। ওদিকে প্রজাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাই তারা জান-প্রাণ দিয়ে খেলায় জিততে চায়। অথচ খেলার নিয়মকানুনে অজ্ঞতা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সৌভাগ্যবশত এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার বোন তাদের গোপনে খেলার কৌশল শেখায়। সেই সুবাদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রজারা ব্রিটিশ দলকে পরাজিত করে। কাহিনিতে ক্রিকেটকে ব্যবহার করে বিদ্যমান হেজিমনি প্রতিস্থাপন ও অ্যান্টি-হেজিমনি উপস্থিত করার চাঞ্চল্যকর পরিবেশনা দেখা যায়।
আজকের পৃথিবীতে প্রাচীন উপনিবেশ এবং বর্তমানে মুক্ত দেশের জন্য ক্রিকেট ঠিক তেমনি এক অ্যান্টি-হেজিমনি। যে কারণে বরাবর ফুলহাতা পরতে অভ্যস্ত সৌরভ গাঙ্গুলী ২০০২–এর ১৩ জুলাই লর্ডসে ইংল্যান্ডের দেওয়া টার্গেট ৩২৬ রানকে অতিক্রম করতে পেরে জার্সি খুলে মাথার ওপরে ঘোরান। যে কারণে আজ সার্বভৌম দেশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল ঔপনিবেশিক শক্তির প্রেতাত্মাকে কথায় কথায় বুড়ো আঙুল দেখায়; ঠিক যেন শেক্‌সপিয়ারের টেমপেস্ট নাটকে প্রভু প্রসপেরোর অধীনে কর্মরত ক্রীতদাস, ক্যালিবান; প্রভুর ভাষা আয়ত্তে এনে তারপর সেই ভাষাতেই প্রতিনিয়ত প্রভুকে আক্রমণ করে।

আফসানা বেগম: কথাসাহিত্যিক ও পিএইচডি গবেষক, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়