>উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য শতরঞ্জি ঢাকাসহ সারা দেশেই এখন পরিচিত। শুধু কি তাই! শতরঞ্জি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। শতরঞ্জির সুদিন ফিরিয়ে আনার নেপথ্যের উদ্যোক্তা সফিকুল আলম সেলিমের কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে
মানুষের যে অসীম ক্ষমতা, সফিকুল আলম সেলিম আবার সে প্রত্যয়টি জাগিয়ে দিলেন। কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের এই প্রতিষ্ঠাতা যেভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে গেলেন, তা এক স্বপ্ন জাগানো গল্প। তিনি নিজের ভাগ্য বদলেছেন। তাঁর এই ভাগ্য বদলানোর গল্পে উত্তরাঞ্চলের অনেক মানুষের ভাগ্যও বদলে গেছে।
সেলিমের সব স্বপ্ন আর অধ্যবসায় শতরঞ্জিকে ঘিরে। তাঁর বিশাল কারখানায় কেবল শতরঞ্জিই তৈরি হয়। তবে শতরঞ্জি কিন্তু আজকের বিষয় নয়। অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি তৈরি হতো। তৈরি হতো রংপুরেও। সে হিসেবে শতরঞ্জি আরও নানা অঞ্চলের মতো রংপুরেরও ঐতিহ্য। প্রথম দিকে এই অঞ্চলে শতরঞ্জিগুলো তৈরি হতো সুতা দিয়ে, পাট দিয়ে নয়। পুরোনো সেই শতরঞ্জি নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এসেছে আজকের অবস্থায়। এর পেছনে অবদান আছে বিসিক, আড়ংসহ অনেকের—বিশেষত হ্যান্ডলুম ও হ্যান্ডিক্রাফটসের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সবার। আশির দশকে বিসিক শতরঞ্জি প্রকল্প নামে নতুন করে একটি উদ্যোগ নেয়। শতরঞ্জির প্রসারে সে প্রকল্পটির ভূমিকা আছে। ১৯৮১ সালে আড়ংয়ের সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম। শতরঞ্জি নিয়ে আমার আগ্রহ তখন থেকেই।
কিন্তু শতরঞ্জি নিয়ে সফিকুল আলম সেলিম যত দূর গিয়েছেন, সেটি অসম্ভব প্রশংসাযোগ্য। তাঁর বড় কৃতিত্ব হলো তিনি শতরঞ্জি তৈরি করেছেন বহির্বিশ্বের বাজারের উপযোগী করে। তাঁর কারখানা থেকে উত্পাদিত হয়ে বাংলাদেশের শতরঞ্জি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর নানা দেশে। গত অর্থবছরে এ রপ্তানির অর্থমূল্য ছিল ৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্প খাতে বর্তমানে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে সফিকুল আলম সেলিমের প্রতিষ্ঠান কারুপণ্য। এ কারণে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছরই প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।
কারুপণ্যের পাশে আজ অনেক অর্জন। যেকোনো প্রতিষ্ঠান যেমন ছোট থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, সেলিমের প্রতিষ্ঠানটি বেড়ে উঠেছে সেভাবেই—নিবিড় ভালোবাসা ও কঠোর অধ্যবসায়ে। দীর্ঘদিন থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি তাঁকে। সব মিলিয়ে সেলিমের উত্থানের যে ছবিটি আমার চোখে ভাসে, তাকে যথার্থই ‘শূন্য থেকে পূর্ণ’ বলা যায়।
শুরুর দিকে, ১৯৮৬ সালে, ক্যানভাসে গমের খড় দিয়ে ছবি তৈরি করে সেলিম হাজির হয়েছিলেন ঢাকার শিল্পমেলায়। সেই তাঁর সূচনা। ১৯৯১ সালে কারুপণ্য নামে একটি হস্তশিল্প বিপণনকেন্দ্র খুললেন নিজের শহর রংপুরে। সেখান থেকে এগোতে এগোতে আজকে তাঁর যে অবস্থান, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সেটা মোটেই মসৃণ ছিল না। তাঁকে যেতে হয়েছে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
২০১৫ সালে সেলিম নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া যাক: ‘আমি বিসিক-এর বন্ধ থাকা শতরঞ্জি প্রকল্প ব্যক্তি উদ্যোগে লিজ গ্রহণ করে পুরোনো কারিগরগণকে সংগঠিত করে নতুন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বল্প পরিসরে শতরঞ্জি উত্পাদন ও বিপণন শুরু করি। বন্ধুরা আসে। আরও আসেন নানা শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। কথাবার্তা হয় রংপুরের প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য শতরঞ্জি নিয়ে। আমার প্রত্যয়, যেকোনো উপায়ে এই শতরঞ্জি-শিল্পকে আবারও জাগিয়ে তুলতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে রংপুরের হৃত গৌরব। আর শতরঞ্জি-শিল্পকে বাঁচাতে চাইলে সর্বাগ্রে দেশে এর নতুন বাজার তৈরি করতে হবে। এরপর আর বসে থাকা নয়, নিজেকে পুরোপুরি বিনিয়োগ করলাম এই স্বপ্নের বাস্তবায়নে। আমার স্ত্রী শীলাসহ আমার ছোট ভাই লেনিন, শামীম এবং আমার বন্ধুরাও আমার পাশে দাঁড়াল সহকর্মী হিসেবে।’
এরপর এক অভিনব গল্প। ক্রেতারা আগ্রহী হলেন তাঁর শতরঞ্জির প্রতি। এবার সেলিম শতরঞ্জি নিয়ে গেলেন রংপুরের বাইরে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করলেন শতরঞ্জির প্রদর্শনী।
২০০২ সালে ঢাকাতেও চালু হলো কারুপণ্যের বিপণনকেন্দ্র। ওই বিপণনকেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম অতিথি। সে বছর জার্মানিতে ডোমোটেক্স নামে বৃহত্তম কার্পেট এক্সপোতে সেই যে তিনি অংশ নিলেন, তাঁর ভাগ্য চিরদিনের জন্য খুলে গেল। বহির্বিশ্বের ক্রেতারা দারুণ পছন্দ করল তাঁর শতরঞ্জি। একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে দুই বছর আগে শতরঞ্জি আমদানি করা দেশের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩টি। তাঁর প্রতিষ্ঠানে উত্পাদিত শতরঞ্জি এখন রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার ৫৫টি দেশে।
কারুপণ্য শতরঞ্জি বানাচ্ছে সম্পূর্ণ হস্তচালিত তাঁতের দেশি প্রযুক্তিতে, অকিঞ্চিৎকর উপাদানে। গার্মেন্টসের বর্জ্য, ঝুট, কাঁচা পাট, পাটের সুতলি, পুনর্ব্যবহৃত সুতায় তৈরি হচ্ছে বাহারি নকশা ও আকারের রপ্তানিযোগ্য শতরঞ্জি।
কারুপণ্যের এখন দুটো কারখানা—দুটোই রংপুরে। একটি রবার্টসনগঞ্জে, আরেকটি লাহিড়ির হাটে। এ দুই কারখানায় কাজ করছেন পাঁচ হাজার কারিগর। কারিগরদের ৯০ শতাংশই নারী। প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি সেলিমের ভাবনার এক মমতাময় কেন্দ্র। আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক নারী কর্মীই আসেন সাইকেল চালিয়ে। তাঁদের শিশুসন্তানদের জন্য কারখানায় রয়েছে দিবাযত্ন কেন্দ্রসহ আরও নানা সুবিধা।
শতরঞ্জি নিয়ে সেলিম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন প্রায় তিন দশক আগে। মাঝখানে গেছে তাঁর অসম্ভব এক সংগ্রামের সময়। তারই ফসল আজ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শতরঞ্জির অভূতপূর্ব অবস্থান।
লেখক: ডিজাইনার; সভাপতি, কারুশিল্পী পরিষদ