বগুড়ার সূরা অ্যাগ্রো ফার্মে আমরা যখন পা রেখেছি, রাকিবুল ইসলাম তখন গরুকে খাওয়াতে ব্যস্ত। ছোট ভাই শাহারিয়ার ইসলামকেও পাওয়া গেল; বিশালদেহী গরুগুলোকে যত্ন নিয়ে গোসল করাচ্ছিলেন তিনি।
দেখে কে বলবে—এক ভাই যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল শহরের কেলে ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় স্নাতক করেছেন। অন্যজন কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে (সিএসই) স্নাতক।
দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দুই ভাই কেন, কীভাবে খামারের ব্যবসায় ঝুঁকলেন?
বগুড়া শহরের কাছেই সদর উপজেলার বানদীঘি সোনারপাড়ায় বাবার জায়গায় ‘সূরা অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে আধুনিক খামার গড়েছেন রাকিবুল ইসলাম। পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ছোট ভাই শাহারিয়ার। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এবার ৪২টি গরু মোটাতাজা করেছেন তাঁরা। তাঁদের ডেইরি ফার্মে আছে পাঁচটি গাভি ও চারটি বাছুর। প্রতিদিন গড়ে মেলে ১০০ লিটার দুধ। এসব দুধ পাস্তুরিত ও প্যাকেটজাত করে প্রতি লিটার ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বগুড়া শহরের বিভিন্ন দোকানে। এ ছাড়া বিদেশি নেপিয়ার ঘাসের চাষ করছেন তাঁরা। তিন বিঘা পুকুরে চলছে মাছ চাষ। আছে বিদেশি শৌখিন পাখিও।
বিলেত থেকে পড়ালেখা শেষ করে এসে গরুর খামার কেন? তা-ও কম্পিউটার প্রকৌশলী ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে?
রাকিবুল ইসলামের সোজাসাপটা জবাব, ‘বড় কিছু করার স্বপ্ন নিয়েই তো দেশে ফিরেছিলাম। ২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনার ঘরবন্দী, একঘেয়ে জীবন শুরু হলো। এর মধ্যে বগুড়ার তৌহিদ পারভেজ ভাইয়ের খোঁজ পেলাম। নিউজিল্যান্ড থেকে পড়ালেখা করে এসে তিনি সফল খামারি হয়েছেন। তাঁর খামারে মাসখানেক কাজ করে গরু লালন–পালনের কৌশল শিখলাম। গরুকে খাওয়ানো, গোসল করানো থেকে শুরু করে সব হাতে–কলমে শিখেছি। এরপর নিজ গ্রামে খামারের শেড ও অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করি।’
ছোট ভাই শাহারিয়ারের ইচ্ছে ছিল স্নাতক শেষে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করবেন। করোনার কারণে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। ঢাকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষে এখন সেখানেই স্নাতকোত্তর করছেন তিনি। সঙ্গে চলছে খামারের কাজ।
রাকিবুল জানালেন, গত বছর কোরবানির ঈদের পাঁচ মাস আগে ৪০টি গরু নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। অবকাঠামো নির্মাণ ও গরু কেনাসহ তাঁর বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অনলাইনে গরু বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা লাভ হয় তাঁদের। ঈদের পর নতুন করে ৫০টি গরু ও ৫টি গাভি কিনে আবার নতুন করে শুরু করেন তাঁরা। এখন রাকিবুলদের সঙ্গে কাজ করছেন চারজন শ্রমিক।
খামারের শ্রমিক গাবতলীর পাঁচকাতুলী গ্রামের আবদুর রহমান বলছিলেন, ‘গরুক কী খাবার দেওয়া লাগবি, কখন গোসল করান লাগবি, সমস্যা হলে কখন কী করতে হবি, সব দুই ভাই-ই দেকিচ্চে। হামরা খালি তারগরক সহযোগিতা করিচ্চি। মাস গেলে ১৫ হাজার টেকা মজুরি পাচ্চি। সেই টেকা দিয়ে সংসার চলিচ্চে, দুই বেটিক লেকাপড়া করাচ্চি।’
শাহারিয়ার জানালেন, তাঁদের খামারে শাহিওয়াল জাতের ৪২টি গরুর ওজন হয়েছে ২৫০ থেকে ৫২৫ কেজি পর্যন্ত। ৫২৫ কেজি ওজনের এঁড়ে গরু বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। আস্ত গরুর ওজন মেপে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। গত বছর এঁড়ে গরুর দাম ছিল ৪০০ টাকা। শাহারিয়ার বললেন, ‘শুধু গরুর খামারের আয় থেকে লাভ করা কঠিন। তাই আমরা মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি দুধের খামার করেছি। পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছ। দিন দিন খামারের পরিধি বাড়ছে। কানাডায় পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল। এখন সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে খামারের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর স্বপ্ন দেখছি।’
রাকিবুল বলেন, ‘বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসে যখন গরুর খামার শুরু করলাম, তখন আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ “গরুর ব্যাপারী” বলে ঠাট্টা করেছেন। কিন্তু বাবা আমাদের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের কাজে তাঁর পুরোপুরি সায় ছিল।’
রাকিবুল ও শাহারিয়ার দুজনই এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন বগুড়ার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। ব্যবসায়ী পরিবারে তাঁদের বেড়ে ওঠা। বাবা রফিকুল ইসলাম প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। তাঁর রড-সিমেন্টের স্থানীয় পরিবেশকের ব্যবসাও আছে ।
গরুর ব্যবসায় পরিবারের কেউ কখনো যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু রাকিবুল জানালেন, এই স্বপ্ন তিনি শৈশব থেকেই দেখেছেন। বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে কোরবানির ঈদের সময় হাটে যেতাম। ঘুরেফিরে পছন্দসই গরু কেনার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। বিশাল বিশাল গরু দেখে খুব অবাক হতাম। কীভাবে এগুলোর লালন–পালন করা হয়, খামারিদের কাছ থেকে গল্প শুনতাম। সেই থেকে একটা টান ছিল। কিন্তু বিলেতে পড়ে এসে গরুর ব্যবসা করব, এতটা আসলে কখনোই ভাবিনি।’
‘সূরা অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন গরুর হাট জমে উঠেছিল গত বছর। এবারও দুই ভাই অনলাইন হাটে বিক্রিবাট্টা শুরু করেছেন। রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘ভবিষ্যতে খামারের গরুর দুধ থেকে উৎপাদিত ঘি ও দুগ্ধজাত পণ্য অনলাইনে বিক্রির ইচ্ছে আছে।’
কথা হলো বগুড়া জেলার অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মাসুদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুজন শিক্ষিত তরুণ পড়ালেখা শেষ করে গরুর খামার গড়েছেন, এটা নিশ্চয়ই একটা ভালো উদাহরণ। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে উদ্যোগী হলে বেকারত্ব দূর হবে, চাঙা হবে দেশের অর্থনীতি।’