অ্যাডভেঞ্চার আমার ভালো লাগে। তবে সুযোগ তো আর সব সময় মেলে না। তাই প্রতিদিনের জীবনেই তাকে খোঁজার চেষ্টা করি। বাসা থেকে অবশ্য দুঃসাহস দেখানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু আমি কি সেসব শোনার পাত্র নাকি!
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ি তখন। ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে ছুটি শেষ হয়ে এল। ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে, তাই খুলনা ফিরছিলাম।
দুপুরের দিকে মাওয়া ঘাটে পৌঁছালাম। ফেরি ওপারে। এপারে আসতে অনেক সময় লাগবে। তাই বাস থেকে নেমে সিদ্ধান্ত নিলাম লঞ্চে যাব। মাওয়া ঘাটে যাঁদের যাতায়াত, তাঁরা জানেন ভরা বর্ষায় লঞ্চে নদী পার হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবু কিছু মানুষ হরহামেশাই পারাপার হচ্ছে। যাদের অনেকেই হয়তো লঞ্চে উঠেছে বাধ্য হয়ে, আমি উঠলাম অ্যাডভেঞ্চারের জন্য।
দূরের আকাশটা কালো হয়ে আছে। একটু বাতাসও অনুভব করছি। নড়বড়ে, রংচটা লঞ্চের ছাদে বসে আছি। যাত্রীদের কাউকে তেমন বিচলিত মনে হচ্ছে না। ভালোই চলছিল সব। কিন্তু মাঝনদীতে আসার পর হঠাৎ বাতাসের গতি একটু বাড়ল। সঙ্গে নামল বৃষ্টিও। নিকষ কালো মেঘের জন্য নদীর পানিও কেমন যেন কালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল খেপে আছে কারও ওপর। ঢেউ ছিল বিশাল আকারের।
বৃষ্টি নামতেই মানুষের ছোটাছুটি শুরু হলো। সবাই ছাদের নিচে আশ্রয় নিতে চাইল। ঠিক সেই সময়ই লঞ্চটা বাঁ দিকে কাত হয়ে গেল। এই প্রথমবার ভয়ের অনুভূতি আমাকে গ্রাস করল। নিজের ভেতরেই প্রশ্নটা গুমরে উঠল, লঞ্চটা কি তাহলে ডুবে যাবে?
কিছুটা দূরে, হয়তো পেছনের সারি থেকে কে যেন জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সবাই শান্ত থাকেন। কেউ ছোটাছুটি করবেন না।’ লঞ্চটা তখন খেলনার মতো দুলছিল। বুঝতে পারলাম যেকোনো মুহূর্তে ডুবে যাবে। অনেকেই কান্নাকাটি শুরু করল। বেঁচে থাকার আকুতি সবার মধ্যে। ফ্যাকাশে মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আমারও সব ওলটপালট হয়ে গেল। কাঁদতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু পারছিলাম না। মৃত্যুর আগে নাকি সবার প্রিয় মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমার তেমন কিছুই হচ্ছিল না। বরং বেদনা, হাহাকার, ভয় একসঙ্গে আমার বুকের মধ্যে জমাট বেঁধে ছিল।
আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। বড় বড় ঢেউয়ের কারণে লঞ্চের মধ্যে পানি ঢুকে যাচ্ছে। সামনে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না। লঞ্চটা যখন বেশি কাত হয়ে যাচ্ছিল, তখন মানুষের চিৎকারে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। এমন সময় কেউ একজন বলল, ‘ওই যে দূরে কূল দেখা যায়। সবাই আল্লাহরে ডাকেন। কেউ ছোটাছুটি কইরেন না।’
চিৎকার-হইচই চলতে লাগল। আমি পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছি। কানে কিছু ঢুকছে না। শুধু বাতাস আর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। উপলব্ধি করলাম, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার মতো ভয়ংকর আর কিছু নেই। প্রতিটা মুহূর্তেই যেন আমি এক একবার করে মারা যাচ্ছি। কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না। ঢেউ, লঞ্চের দুলুনি— সব যেন সহ্য হয়ে গিয়েছিল। ঘোর কাটল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম লঞ্চ কূলে ভিড়েছে।
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম, বেঁচে থাকার আনন্দে। বৃষ্টির মধ্যে মিশে গেল কান্নার জল।
ঢাকা