বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণত কোনো প্রতিযোগিতাকে সামনে রেখেই গড়ে ওঠে একেকটা দল। কিন্তু ব্র্যাকইউ ডুবুরি দলের প্রতিষ্ঠালগ্নে সামনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। মূলত বাংলাদেশের লঞ্চ দুর্ঘটনাসহ নৌপথের নানা সমস্যার সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে ব্র্যাকইউ ডুবুরি। দলনেতা আদনান সাব্বিরের সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন। সেই সময় থেকেই রোবোটিকসপ্রেমী এই দল শুরু করে পানির নিচের যান (আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল) বানানোর কাজ।
বর্তমানে এই দলের নেতা নাঈম হোসেন। তিনি বলছিলেন, ‘একজন ডুবুরি পানির তলদেশে গিয়ে যে তথ্যগুলো আনেন, সেটা যদি একটা রোবট করতে পারে, তাহলে সময় ও শ্রম দুই–ই বাঁচবে। এই ভাবনা থেকেই ব্র্যাকইউ ডুবুরি। পরিকল্পনা করার পর থেকেই আমরা পুরোদমে গবেষণা শুরু করি। এরপর এইউভি (অটোনমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল বা পানির নিচের স্বয়ংক্রিয় যান) তৈরির চেষ্টা করলাম, যেটা মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে পানির নিচে কাজ করতে পারবে। কাজ শুরু করার পর টের পেলাম, এ–সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কিছুই বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। সে সময় আমাদের কোনো স্পনসরও ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফান্ড চাওয়ার মতো কিছু তৈরি করতেও পারিনি। তাই একদম স্থানীয় ও কম দামে পাওয়া যায়, এ রকম কিছু যন্ত্রপাতি ও পিভিসি দিয়ে একটা এইউভি দাঁড় করাই।’
নিজেদের গড়া এই এইউভি নিয়ে ২০১৮ সালে ‘সিঙ্গাপুর অটোনমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল চ্যালেঞ্জে (এসএইউভিসি)’ অংশগ্রহণ করে ব্র্যাকইউ ডুবুরি। মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের অবস্থান যাচাই। তারপর কীভাবে সামনে এগোলেন? নাঈম বলেন, ‘আমাদেরটা ছাড়া বাকি এইউভিগুলো অনেক আধুনিক ছিল। ওরা যেসব সেন্সর ব্যবহার করেছিল, সেগুলো আমাদের কাছে ছিল না। তারপরও আমরা বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে বিকল্প উপায়ে নির্দিষ্ট ধাপগুলো পেরিয়েছিলাম। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ছাড়াই আমাদের এই চেষ্টা দেখে আয়োজক ও প্রতিযোগিতার স্পনসররা প্রশংসা করেছিলেন। সেবার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে আমরা সপ্তম হই। দেশে ফিরে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো আর্থিক প্রণোদনাও পাই। ভালো একটা প্রকল্প নিয়ে পরেরবার সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কপাল খারাপ, করোনার কারণে যাওয়া হয়নি।’
বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ও মর্যাদাপূর্ণ আন্ডারওয়াটার ভেহিকেল প্রতিযোগিতা হলো ‘রোবোসাব’। প্রতিযোগিতাটির ২৫তম সংস্করণ রোবোসাব ২০২২-এর প্রাথমিক পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে ব্র্যাকইউ ডুবুরি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী জুলাই মাসে মূল পর্বে অংশগ্রহণের জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। ভালো ফলের ব্যাপারে আশাবাদী দলের সদস্যরা।
‘দেশের বাইরের প্রতিযোগীরা যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করেন, আমরা সেগুলো সহজে পাই না। যদিও ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এ ছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সুইমিংপুল দরকার হয়। যেহেতু আমাদের নিজের কোনো সুইমিংপুল নেই, তাই বাণিজ্যিক সুইমিংপুল ব্যবহার করতে হচ্ছে। তবে ফান্ডিং থেকে শুরু করে পুরো বিষয়টিতেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা পাচ্ছি। প্রকল্পের কাজে কোথাও যেতে হলে বা প্রতিযোগিতা থাকলে আমাদের ক্লাস পরীক্ষার বিষয়গুলো আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়,’ বলছিলেন দলের অন্যতম সদস্য জিহাদুল করিম। উন্নত গবেষণার জন্য পৃষ্ঠপোষক প্রয়োজন, সে কথাও জোর দিয়ে বললেন তিনি। জিহাদুলরা মনে করেন, সরকার বা নৌবাহিনীর সহায়তা পেলে আরও উন্নত মানের এইউভি তৈরি করতে পারবেন তাঁরা।
ব্র্যাকইউ ডুবুরি দলের পুরোনো সদস্যদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করে পেশাজীবনে প্রবেশ করেছেন। যুক্ত হয়েছেন নতুনেরা। দলের বর্তমান সদস্যরা হলেন নাঈম হোসেন, ফাহিম আবরার, মাসুম বিল্লাহ, জিহাদুল করিম, নাভিন নায়ার ও আবদুল্লাহ রাফি।
শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সহযোগী অধ্যাপক খলিলুর রহমান। তিনি তাঁর দল নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। বলছিলেন, ‘আমরা তো অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা দেখলাম, এতটুকু বলতে চাই যে আমাদের ছেলেরা পিছিয়ে নেই। ওদের যথেষ্ট মেধা আছে, ইচ্ছাশক্তি আছে। দরকার শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রতিভা বিকাশের মঞ্চ। ক্লাস, পরীক্ষা, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সবকিছু সামলে একটা প্রকল্প নিয়ে দিনরাত কাজ করা, সেটাকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করা সত্যিই গর্বের। তবে এই শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিগত সহশিক্ষার মাধ্যমে বাস্তব জীবনেও উপকৃত হচ্ছে। আমাদের পেশাজীবনে নানা রকম সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়, নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়, অন্য প্রতিষ্ঠানেরও খোঁজ রাখতে হয়। এই শিক্ষাগুলো ওরা পেয়েছে।’