মনোজগৎ

রোগ নিয়ে অহেতুক উদ্বেগ নয়

রোগীর সামনে নেতিবাচক কথা বলা ঠিক না।
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

শারীরিক রোগ নিয়ে বরাবরই ‘অতিরিক্ত’ চিন্তিত সুমন (ছদ্মনাম)। মনে মনে ভয়ে থাকেন, এই বুঝি কোনো বড় রোগ শরীরে অনাহূতের মতো শরীরে বাসা বেঁধে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। তাই ফাঁক পেলেই রোগ নিয়ে ইউটিউবের নানা হেলথ চ্যানেল দেখা, গুগল করা তাঁর অন্যতম কাজ। সম্প্রতি তাঁর প্রতিবেশী করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই গলাব্যথা যে শুরু হলো, কিছুতেই যেন সেটা কমছে না। নানা মানুষের কাছে নানা ভয়ের কথা শুনে উদ্বেগ বাড়ে আর ধীরে ধীরে যোগ হয় খাবার গিলতে কষ্ট, মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় আর ওজন কমে যাওয়া।

দেশে-বিদেশে শরীরের নানা পরীক্ষা করেও চিকিৎসকেরা সবকিছুই তাঁর স্বাভাবিক বললেও উপসর্গগুলা ঠিকই থেকে যায়। সমস্যাগুলো ইদানীং আরও বেড়ে যায় যখন তাঁর বন্ধুবান্ধব তাঁর উপসর্গ শুনে আঁতকে ওঠেন এবং কয়েকজন ‘ক্যানসার’ হওয়ার আশঙ্কা করেন। কিন্তু সুমনের এ গলাব্যথা, গিলতে সমস্যা, ওজন কমে যাওয়া কি আসলেই কিছু নয়, নাকি কোনো রোগেরই উপসর্গ?

আসলে সুমন শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে ‘শরীর নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা’ রোগে ভুগছেন। আর এ উদ্বেগের কারণেই ওপরে বলা শারীরিক উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে। তবে সুমনের মতো শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার সমস্যা কিন্তু অনেকেরই। শরীরের সামান্য উপসর্গ হলেই সেটা বড় শারীরিক রোগ হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করেন। যেমন কোনো কারণে বুকে একটু চাপ চাপ অনুভব করে মনে হয় হার্টের কোনো রোগ হয়েছে, মাথাব্যথা হলে মনে হয় টিউমার হয়েছে ইত্যাদি। ফলে ব্যক্তি ভয় পান বা উদ্বিগ্ন হন।

মানুষ উদ্বিগ্ন হলে মস্তিষ্কের কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ হয়, যা মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক জৈব প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। যেমন ভয় পেলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘাম হওয়া বা বুকে চাপ লাগা বা যেকোনো শারীরিক উপসর্গ হতে পারে। এসব উপসর্গে উদ্বিগ্ন ব্যক্তির রোগ নিয়ে ভুল ধারণা আরও গভীর হয়। ফলে উদ্বেগ বেড়ে যায় এবং সংগত কারণে রোগের উপসর্গও বেড়ে যায়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির কোনো শারীরিক রোগ থাকলেও রোগ নিয়ে নিকটজনের অতি উদ্বেগ–আশঙ্কাও বাড়তি উপসর্গ তৈরি করে। এটি ব্যক্তির রোগের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে ।

রোগ নিয়ে এ অহেতুক উদ্বেগ কমানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা আশপাশের মানুষের করণীয় কী?

কাছের মানুষেরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন?

  • রোগীর উপসর্গ শুনে তাঁর সামনে আঁতকে উঠবেন না।

  • রোগ নিয়ে নেতিবাচক বা মনগড়া কোনো তথ্য দেবেন না। যেমন অমুকের এমন হয়েছিল, অমুক পরীক্ষা করাও ইত্যাদি।

  • রোগের উপসর্গে আপনি উদ্বিগ্ন হলেও সেটা প্রকাশ না করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকুন।

  • উপসর্গ নিয়ে তাঁর মনের অবস্থা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং ইতিবাচক কথা বলুন, আশ্বস্ত করুন।

উদ্বেগ কমাতে রোগী যা করবেন

অতিরিক্ত উদ্বেগ যখন রোগের উপসর্গের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়, অনেক সময় চিকিৎসকেরাও রোগীকে বলি, ‘বেশি চিন্তা থেকে এমন হচ্ছে, টেনশন করবেন না, রিল্যাক্সড থাকুন।’ কিন্তু দুশ্চিন্তা এমনই একটা বিষয়, যা মাথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই চলে আসে। কারণ, উদ্বেগ একধরনের জৈবিক প্রতিক্রিয়া। তবে কিছু আচরণ, অভ্যাস এ উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে। কাজেই এগুলো পরিহার করলে রোগ নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা হলেও এড়ানো যায়।

  • শারীরিক পরীক্ষায় আপনার রিপোর্ট স্বাভাবিক এলে এবং চিকিৎসক আপনাকে ‘শারীরিকভাবে’ সুস্থ বলার পরও উপসর্গ দেখা গেলে মনে রাখতে হবে অতিরিক্ত উদ্বেগ এর অন্যতম কারণ। মনে রাখবেন, এ উপসর্গ আপনাকে সাময়িকভাবে কষ্ট দিলেও ভয়ের কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে শরীরের উপসর্গকে অহেতুক গুরুত্ব দেওয়া (বড় ধরনের রোগ ভেবে নেওয়া, মনোযোগ দেওয়া, অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ করা) থেকে বিরত থাকুন। গুরুত্ব আপনার উদ্বিগ্নতাকে এবং ফলশ্রুতিতে উপসর্গ বাড়িয়ে দিতে পারে।

  • রোগ নিয়ে ইন্টারনেটে অতিরিক্ত তথ্য খোঁজা (সার্চ), ইউটিউব দেখা বা চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের সঙ্গে আলোচনা কমিয়ে দিন। রোগ সম্পর্কে নানা তথ্য আপনার উদ্বেগ বাড়াবে, যা আপনার উপসর্গ বাড়ানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে।

  • রোগ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা হলে সেটা প্রশ্রয় না দিয়ে বেশ কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম আপনার উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। উপসর্গসমূহও কমে আসবে। মনে রাখবেন, আপনি যদি শরীর নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার রোগে ভুগে থাকেন, তবে রোগের নিয়ন্ত্রণ কিন্তু অনেকখানিই আপনার হাতে। হাঁটুন, ব্যায়াম করুন, নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখুন, ভালো থাকুন।