চিকিৎসক নয়, শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন সায়েবা আখতার। তবে তিনি হয়েছেন চিকিৎসক। একই সঙ্গে দেশের হাজারো চিকিৎসকের সম্মানিত শিক্ষকও তিনি। প্রসব–পরবর্তী রক্তপাত বন্ধে তাঁর উদ্ভাবিত সায়েবাস মেথড কিংবা অসহায় নারীদের ফিস্টুলা বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচারের জন্য ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথ’-এর মতো প্রতিষ্ঠানসহ আরও অনেক সেবামূলক কাজের পেছনে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো রোগীদের বন্ধু হওয়া। এই অর্জন তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক এনে দিয়েছে।
পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামে হলেও বাবার কর্মসূত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া সা’দত কলেজের মনোরম ক্যাম্পাসে, যেখানে তাঁর বাবা শিক্ষকতা করতেন। তাঁরা ছিলেন পাঁচ বোন, দুই ভাই।
স্কুলজীবন শুরু হয় টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ে। স্কুলজীবন শেষে ভর্তি হন করটিয়ার সা’দত কলেজে। পছন্দের বিষয় ছিল গণিত। খুব ইচ্ছা ছিল গণিতের শিক্ষক হবেন। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর ওখানেই প্যাথলজির প্রভাষক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সালে ‘অবসটেট্রিকস ও গাইনোকোলজি বিষয়ে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৮ সালে চিকিৎসক মো. জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গে বিয়ে হয় সায়েবা আখতারের। তাঁদের চার সন্তান জাকিয়া কবির, সারোয়াত জাহান কবির, মারগুব কবির ও সুমাইয়া কবির।
সায়েবা আখতার বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করার মাধ্যমে অগণিত নারীকে সেবা দিয়েছেন। কাজ করেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, পিজি হাসপাতাল (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেলে টানা ১১ বছর অধ্যাপনার পর ২০০৬ সালে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং বিএসএমএমইউ হাসপাতালের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে অধ্যাপনা করেন তিন বছর। এ ছাড়া বিশ্বের বেশ কিছু দেশে কাজ করেছেন সায়েবা আখতার।
২০০০ সালে সায়েবা আখতার ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রসূতি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় একজন বিদেশি প্রশিক্ষক রিচার্ড জোহানসন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের একটি প্রশিক্ষণ দিতে আসেন। তাঁর কাছ থেকে সায়েবা আখতার নারীদের প্রসব–পরবর্তী রক্তপাত বন্ধের (পিপিএইচ) চিকিত্সায় ব্যবহৃত প্রায় ৩০০ ডলার মূল্যের একটি বেলুন চেয়ে রাখেন। এই বেলুনটিই ছিল তখন পিপিএইচ মোকাবিলার একমাত্র অস্ত্র। যদিও উন্নত বিশ্বে এটি কেবল একবার ব্যবহারযোগ্য, তবু জীবাণুমুক্ত করে এই একটি বেলুনই বারবার ব্যবহার করা হতো ঢাকা মেডিকেলে। একদিন এক জন্ডিসে আক্রান্ত মায়ের প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য বেলুনটি ব্যবহার করা হয়। তারপর দুর্ভাগ্যবশত বেলুনটি হারিয়ে যায়।
ওই ঘটনার ঠিক পরদিন হাসপাতালে প্রসব–পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একজন মারা যান। তারপর থেকে সায়েবা আখতার এর সমাধান নিয়ে ভাবতে থাকেন, ও রকম একটি বেলুন থাকলে বোধ হয় ওই নারীকে বাঁচানো যেত। অবশেষে তাঁর মনে হয়, যেহেতু কনডম একটি মেডিকেল ডিভাইস, তাই এটিকে জরায়ুর ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ফুলিয়ে দিতে পারলে হয়তো কাজ হবে। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখলেন, একজন মায়ের প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পেরে তাঁর জরায়ু কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সহকর্মীরা। তিনি তাঁদের একটু অপেক্ষা করতে বললেন। একটি কনডম ক্যাথেটারের সঙ্গে বেঁধে রোগীর জরায়ুতে প্রবেশ করালেন, তারপর তা ফুলিয়ে দিলেন স্যালাইন দিয়ে। মাত্র ১৫ মিনিটেই বন্ধ হয়ে গেল রক্তক্ষরণ। পুরো প্রক্রিয়াটিতে খরচ হয় ১০০ টাকার কম। তারপর ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২৩ জন রোগীর ওপর সফলভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন সায়েবা আখতার ও তাঁর চিকিৎসক দল।
২০০৩ সালে তাঁর এই গবেষণালব্ধ ফল মেডস্কেপ নামের বিশ্বের শীর্ষ সারির মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন এবং পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিও পেয়েছে।
১৯৮৮ সালে বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজে থাকাকালীন ফিস্টুলা নিয়ে কাজ শুরু করেন সায়েবা আখতার। সেখানে আটটি শয্যা পৃথক করে চালু করেন দেশের প্রথম ফিস্টুলা ওয়ার্ড। এ ছাড়া দেশের নানা প্রান্তে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ‘ফিস্টুলা ক্যাম্প’-এর মাধ্যমে তিনি এসব রোগীর অস্ত্রোপচার করেছেন। তাঁর উদ্যোগে এবং সরকার ও ইউএনএফপিএর সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে গড়ে উঠেছে ‘ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার’। ২০১২ সালে তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ থেকে সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অর্থ সহায়তায় ঢাকার নিউ ইস্কাটনে চালু করেন ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২০ শয্যার এই দাতব্য হাসপাতালে ফিস্টুলা, প্রোলাপ্স, পেরিনিয়াল টিয়ারসহ আরও কিছু প্রসবজনিত জটিলতার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। হাসপাতালটিতে রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও আছে।
অধ্যাপক সায়েবা আখতার নারী স্বাস্থ্যের উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে ও বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০২০ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল